১২:০৮ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৩ মে ২০২৪

অবকাঠামো বনাম আর্থ সামাজিক উন্নয়ন

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় : ১২:২৫:২০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩
  • / ২৯
সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

হিমাদ্রি শেখর ভদ্র:-

ইট পাথরের উন্নয়ন আর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এক না। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, সুনামগঞ্জে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জেলার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা, কৃষি, প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ খাতে অভাবনীয় উন্নয়ন হয়েছে।
অবকাঠামোগত উন্নয়ন অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নুতন বহুতল ভবন নির্মাণ, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এ নুতন ভবন নির্মাণ, নুতন সড়ক, সেতু, কালভার্ট, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট,নার্সিং কলেজ, মেডিকেল ট্যাকনোলজি প্রতিষ্টান, পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে।
বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে সরাসরি অতিদরিদ্র গৃহহীন মানুষ সরাসরি উপকৃত হয়েছেন। তাদের উদ্বাস্তু জীবনের অবসান হয়েছে। আধা পাকা ঘরে তারা নিরাপদে বসবাস করছেন।
সরকার সামাজিক খাদ্য নিরাপত্তা খাতে নারীপুরুষ বয়স্ক-ভাতা, বিধবা-ভাতা, প্রতিবন্ধি ভাতা, মাতৃত্ব-ভাতা সহ বিভিন্ন ভাতা পাচ্ছেন। মেয়েরা বিনা বেতনে স্কুল কলেজে পড়ালেখার করছে তারা বিনামূল্যে পাঠ্যবই পাচ্ছে। দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা উপবৃত্তি পাচ্ছে।
অন্যদিকে গ্রামের মানুষের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, কৃষিতে ৭০ ভাগ ভুর্তুকি মূল্যে হারভেস্টার মেশিন প্রদান, খামার যান্ত্রিকী করণ প্রকল্পে কম্নাইন্ড হারভেস্টার, পাওয়ার টিলার, মাড়াই মেশিন, রিপার, ড্রাম সিডার ইত্যাদি আধুনিক মেশিনারিজের সংযোজন হয়েছে। এতে কৃষক উপকৃত হয়েছেন। ফসল উৎপাদনে সাশ্রয় হয়েছে সময় ও অর্থ, শ্রমিক। এগিয়েছে কৃষি ও কৃষক।
অসংখ্য হাওর নিয়ে গঠিত সুনামগঞ্জ। জেলায় কৃষি কাজ, মাছ ধরা ছাড়া বিকল্প কর্মসংস্থান নেই। একমাত্র বোরো ফসল নির্ভর হাওর অর্থনীতি। প্রাকৃতিক কারণে বছরে ৬ থেকে ৮ মাস পানিতে ডুবে থাকে হাওর । এসময় ব্যবহার অযোগ্য থাকে ভূমি।
দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের মেঘালয় পাহাড় বেস্টিত সুনামগঞ্জ। এখানে আগাম বন্যায় ফসলহানির ঘটনা ঘটে। বছরে কম করে হলেও দুই তিনবার বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। শিলাবৃষ্টি বজ্রপাত সহ নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হন হাওরবাসী।
সুনামগঞ্জে অপুষ্টি দারিদ্রতা, নিম্ন মুখী শিক্ষার হার, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব রয়েছে। মানসম্মত শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাবে প্রাথমিক মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা ইংরেজি,গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে খুব দুর্বল। দূর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে মেধাবীরা হাওরাঞ্চলে চাকরি করতে চান না। তারা চেষ্টা তদবির করে বদলি হয়ে যান উন্নত এলাকায়। স্বাভাবিক ভাবে এর খারাপ প্রভাব পড়ে হাওড়বাসীর জীবনে।
স্বচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরা শহরমুখী তারা বড়বড় শহরের ডাকসাইটে স্কুল কলেজে পড়াশোনা করেন। দরিদ্র শিক্ষার্থীরা গ্রামের প্রতিষ্ঠানে শহরের চেয়ে কম সুযোগ সুবিধা নিয়ে লেখাপড়া করে। এজন্য গ্রাম আর শহরের শিক্ষার্থীর শিক্ষার গুণগত মানে অনেক পার্থক্য হয়।
জেলার প্রাইমারি স্কুলের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী সকালের খাবার না খেয়ে স্কুলে আসে। দ্বিতীয় শিফটের অনেকেই দুপুরে খাবার না খেয়ে ক্ষুধার্ত পেটে স্কুলে আসে। গুনীজনরা বলেন, খালি পেটে না হয় বিদ্যা শিক্ষা না হয় জ্ঞান অর্জন।
হাওর এলাকার শিশু,কিশোর,কিশোরী সুষম খাবারের অভাবে অপুষ্টিতে আক্রান্ত। পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে তাদের দৈহিক গঠন খাটো ও কম ওজনের হয়। মায়েরা গর্ভাবস্থায় সুষম পুষ্টিকর, পর্যাপ্ত খাবার খাওয়ার সামর্থ্য নেই। তাই খেতে পারেন না। পরিবার থেকে পায়না প্রসুতি মায়ের সঠিক পরিচর্যা। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কম ওজনের শিশু জন্মদেন।
পারিবারিক অভাব অনটনের কারণে শিশুরা লেখাপড়া বাদ দিয়ে যুক্ত হয় ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে। একই কারণে কিশোরীরা বাল্যবিবাহের স্বীকার হয়। দারিদ্র্য দূর করতে নিজ গ্রাম ছেড়ে অনেক পরিবার সন্তানাদিসহ পোষাক শ্রমিকের কাজ করেন। তারা ঢাকা,গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ মুন্সিগঞ্জ সহ ঢাকার আশপাশের জেলায় বাস করেন। খুপরি ঘর ভাড়া নিয়ে এক বা দুই রুমের বাসায় গাদাগাদি করে বছরের পর বছর পার করেন। পরিবারের নারী পুরুষ সবাই একই কাজ করেন।
হাওর পাড়ের যুবকরা চট্টগ্রামে বিভিন্ন জেলায় কৃষিকাজ করতে যান। গ্রামের ভাষায় যাকে বলা হয় উজানে গেছে । বছর দশেক আগে হাওর এলাকার যুবকের কর্মসংস্থানের প্রধানকেন্দ্র ছিলো ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি। পরিবেশ রক্ষার দোহাই দিয়ে এখন পাথর উত্তোলন বন্ধ। তাই তারা আর যায় না।
বেকারদের অনেকেই আষাঢ় মাস থেকে আশ্বিন মাস দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করেন। তাদের আয়-রোজগার দিয়ে বাড়ির সংসার চলে। যুবকরা নির্মাণ শ্রমিক,রাজমিস্ত্রী, যোগালো কামলা, ছাদ কামলা, ঢালাই কামলা, কৃষিশ্রমিক সহ বিভিন্ন পেশায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
এখানকার বেকার জনগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র একটি অংশ জৈষ্ঠ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত হাওর নদীতে মাছ ধরে সংসার চালান । বর্ষায় কাজ থাকে প্রবীণ জনগোষ্ঠী অবসর সময়ে তাস,দাবা ষোলগুটি, নারী ও কিশোরী লুডু, সাপ লডু কড়ি, দশপচিশ, খুতখুত, রশিলাফ, কিশোররা দলবেধে মার্বেল খেলে সময় কাটায়। পুরুষ ও যুবকরা হাটবাজার করা সহ পারিবারিক কাজে ব্যস্ত থাকেন। প্রবীণরা কার্তিক মাস থেকে জৈষ্ঠ মাসে তারা বীজতলা, ক্ষেতরোয়া আগাছা পরিষ্কার করা ধান কাটা সহ কৃষি রিলেটেড বিভিন্ন কাজ করে থাকেন।
হাওর এলাকার ক্ষুদ্র প্রান্তিক মাঝারি শ্রেণির কৃষকরা বৈশাখ থেকে আষাঢ় মাস সুখে শান্তিতে কাটালেও বাকি ৯ মাস কাটে নানান অভাব অনটনের মধ্যে।
এই সরকারের তিন মেয়াদে হাওরাঞ্চলের মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা নেই। এছাড়া শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সেবার গুণগত মান উন্নয়নে অবকাঠামো নির্মাণ ছাড়া আর কোন লক্ষ্য ছিলো না। সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলতে এবং অপুষ্টি দূর করতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।
প্রাথমিক শিক্ষা হলো শিশুর বুনিয়াদি শিক্ষা। শিশুদেখা শিক্ষা জীবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয় প্রাইমারি স্কুলে। এখানে সবচেয়ে মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কম্পিউটার,গণিত ইংরেজি বিজ্ঞান ও ইন্টারনেট ব্যবহারে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে।
শিক্ষিত অশিক্ষিত অর্ধ শিক্ষিত বেকার যুবক যুবতীদের কাজের ক্ষেত্র তৈরি করতে ব্যার্থ হয়েছে সরকার । সাগর অঞ্চলে মাছ কেন্দ্র করে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে অথচ হাওর এলাকায় তেমন কোন প্রতিষ্ঠান নেই।
প্রতিটি উপজেলায় একটি করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার উদ্যোগ নিলে বেকার সমস্যার সমাধান হতো। উত্তরাঞ্চলের মংগা দূর করেছে সরকার কিন্তু হাওরাঞ্চলের কার্তিক আর চৈত্র মাসের নিদান দূর করতে পারেনি সরকার । চৈত্র ও কার্তিক মাসে সুনামগঞ্জের গ্রামাঞ্চলে সিজনাল অভাব তীব্র হয়।

শিশুদের প্রাথমিক স্কুলে দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। কমপক্ষে সপ্তাহে ৫ দিন দুপুরে ডিম খিচুড়ি খাওয়ানোর প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন। এতে শিশুরা সুস্থ সবল হবে। ক্ষুধামুক্ত পরিবেশে তারা জ্ঞান অর্জন করতে পারবে। বেকার তরুণ তরুণী বৃত্তিমূলক কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বক্ষম ও সুদক্ষ শ্রমিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। স্বাবলম্বী করতে ঋণ দিয়ে উদ্যোগক্তা বানাতে হবে। তাদের উৎপাদিত পণ্য বিপননের জন্য বড়বড় শহর থেকে বিশ্বের যেকোনো দেশে অনলাইন বিপনন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। যাতে তারা পণ্য বিক্রি করে লাভবান হতে পারেন। প্রতিটি ঘরে কর্মক্ষম নারী পুরুষকে প্রশিক্ষণ দিয়ে উদ্যোগক্তা হিসাবে গড়ে তুলতে হবে।
এলাকার প্রতিটি পরিবারের প্রাপ্ত বয়স্ক নারী পুরুষ কে কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে হবে। প্রতিটি বাড়ি জেন একটি ক্ষুদ্র কারখানা বা উৎপাদন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে ওঠে সে ব্যবস্থা করতে হবে।
যাতে পরিবারের নারী পুরুষ সবাই ক্ষুদ্র উদ্যোগক্তা হতে পারেন। প্রতিটি ইউনিয়নে কারাগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করতে হবে। এতে দিনের বেলায় নিয়মিত শিক্ষার্থী ও রাতের বেলায় কর্মক্ষম প্রবীন রা শিখার সুযোগ পান।
মানুষের জীবন মান উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট করতে হলে প্রতিটি মানুষের অর্থ উপাজর্নের যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষা স্বাস্থ্য সচেতনতা পুষ্টিকর খাবার সহ সব কিছুতে অর্থ প্রয়োজন। যতই সচেতন হন না কেন টাকা না থাকলে কোন কিছু করা সম্ভব না।
অবকাঠামো উন্নয়ন প্রয়োজন আছে তবে মানুষের জীবন মান উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট করতে অগ্রাধিকার প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন। যদি এমন হয় অবকাঠামো উন্নয়ন হলো রাস্তাঘাট মেডিকেল কলেজ অনেক কিছু হলো কিন্তু অর্থাভাবে বা যোগ্যতার অভাবে মানুষ এসব সুবিধা কাজে লাগাতে পারলো না। তাহলে এই উন্নয়ন দিয়ে কি হবে।
একজন জনপ্রতিনিধি গল্পের ছলে বলেছিলেন সুনামগঞ্জে অনেক অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হবে এসব প্রতিষ্ঠানের ক্যানটিনে সুনামগঞ্জের ছেলেরা চা, সিংগাড়া,চমুচা, ঝালমুড়ি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে আর অন্য জেলার ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয় এতে সুনামগঞ্জবাসীর কি লাভ হবে ?
হাওরাঞ্চল বাদ দিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা যাবে না। হাওরাঞ্চলকে ডিজিটাল করতে হবে পরে স্মার্ট করতে হবে। এজন্য দরকার বিচক্ষণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও যোগ্য নেতৃত্ব। আগামী নির্বাচনে চোখ কান খোলা রেখে যোগ্যজনকে মনোনয়ন দিতে হবে। কোন ভেজাল চলবে না।
লেখক হিমাদ্রি শেখর ভদ্র : স্টাফ রিপোর্টার সময় টেলিভিশন। সুনামগঞ্জ রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক।


সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

বিজ্ঞাপন

সাবধান
এই পৃষ্ঠার বিষয়বস্তু কপি করতে পারবেন না

অবকাঠামো বনাম আর্থ সামাজিক উন্নয়ন

আপডেট সময় : ১২:২৫:২০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩
সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

হিমাদ্রি শেখর ভদ্র:-

ইট পাথরের উন্নয়ন আর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এক না। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, সুনামগঞ্জে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে জেলার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা, কৃষি, প্রযুক্তি, বিদ্যুৎ খাতে অভাবনীয় উন্নয়ন হয়েছে।
অবকাঠামোগত উন্নয়ন অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নুতন বহুতল ভবন নির্মাণ, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স এ নুতন ভবন নির্মাণ, নুতন সড়ক, সেতু, কালভার্ট, মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট,নার্সিং কলেজ, মেডিকেল ট্যাকনোলজি প্রতিষ্টান, পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র, কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে।
বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশ্রয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে সরাসরি অতিদরিদ্র গৃহহীন মানুষ সরাসরি উপকৃত হয়েছেন। তাদের উদ্বাস্তু জীবনের অবসান হয়েছে। আধা পাকা ঘরে তারা নিরাপদে বসবাস করছেন।
সরকার সামাজিক খাদ্য নিরাপত্তা খাতে নারীপুরুষ বয়স্ক-ভাতা, বিধবা-ভাতা, প্রতিবন্ধি ভাতা, মাতৃত্ব-ভাতা সহ বিভিন্ন ভাতা পাচ্ছেন। মেয়েরা বিনা বেতনে স্কুল কলেজে পড়ালেখার করছে তারা বিনামূল্যে পাঠ্যবই পাচ্ছে। দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা উপবৃত্তি পাচ্ছে।
অন্যদিকে গ্রামের মানুষের ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, কৃষিতে ৭০ ভাগ ভুর্তুকি মূল্যে হারভেস্টার মেশিন প্রদান, খামার যান্ত্রিকী করণ প্রকল্পে কম্নাইন্ড হারভেস্টার, পাওয়ার টিলার, মাড়াই মেশিন, রিপার, ড্রাম সিডার ইত্যাদি আধুনিক মেশিনারিজের সংযোজন হয়েছে। এতে কৃষক উপকৃত হয়েছেন। ফসল উৎপাদনে সাশ্রয় হয়েছে সময় ও অর্থ, শ্রমিক। এগিয়েছে কৃষি ও কৃষক।
অসংখ্য হাওর নিয়ে গঠিত সুনামগঞ্জ। জেলায় কৃষি কাজ, মাছ ধরা ছাড়া বিকল্প কর্মসংস্থান নেই। একমাত্র বোরো ফসল নির্ভর হাওর অর্থনীতি। প্রাকৃতিক কারণে বছরে ৬ থেকে ৮ মাস পানিতে ডুবে থাকে হাওর । এসময় ব্যবহার অযোগ্য থাকে ভূমি।
দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের মেঘালয় পাহাড় বেস্টিত সুনামগঞ্জ। এখানে আগাম বন্যায় ফসলহানির ঘটনা ঘটে। বছরে কম করে হলেও দুই তিনবার বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। শিলাবৃষ্টি বজ্রপাত সহ নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হন হাওরবাসী।
সুনামগঞ্জে অপুষ্টি দারিদ্রতা, নিম্ন মুখী শিক্ষার হার, ব্যক্তিগত ও পারিবারিক স্বাস্থ্য সচেতনতার অভাব রয়েছে। মানসম্মত শিক্ষক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাবে প্রাথমিক মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা ইংরেজি,গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ে খুব দুর্বল। দূর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে মেধাবীরা হাওরাঞ্চলে চাকরি করতে চান না। তারা চেষ্টা তদবির করে বদলি হয়ে যান উন্নত এলাকায়। স্বাভাবিক ভাবে এর খারাপ প্রভাব পড়ে হাওড়বাসীর জীবনে।
স্বচ্ছল পরিবারের শিক্ষার্থীরা শহরমুখী তারা বড়বড় শহরের ডাকসাইটে স্কুল কলেজে পড়াশোনা করেন। দরিদ্র শিক্ষার্থীরা গ্রামের প্রতিষ্ঠানে শহরের চেয়ে কম সুযোগ সুবিধা নিয়ে লেখাপড়া করে। এজন্য গ্রাম আর শহরের শিক্ষার্থীর শিক্ষার গুণগত মানে অনেক পার্থক্য হয়।
জেলার প্রাইমারি স্কুলের বেশির ভাগ শিক্ষার্থী সকালের খাবার না খেয়ে স্কুলে আসে। দ্বিতীয় শিফটের অনেকেই দুপুরে খাবার না খেয়ে ক্ষুধার্ত পেটে স্কুলে আসে। গুনীজনরা বলেন, খালি পেটে না হয় বিদ্যা শিক্ষা না হয় জ্ঞান অর্জন।
হাওর এলাকার শিশু,কিশোর,কিশোরী সুষম খাবারের অভাবে অপুষ্টিতে আক্রান্ত। পুষ্টিকর খাদ্যের অভাবে তাদের দৈহিক গঠন খাটো ও কম ওজনের হয়। মায়েরা গর্ভাবস্থায় সুষম পুষ্টিকর, পর্যাপ্ত খাবার খাওয়ার সামর্থ্য নেই। তাই খেতে পারেন না। পরিবার থেকে পায়না প্রসুতি মায়ের সঠিক পরিচর্যা। তাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কম ওজনের শিশু জন্মদেন।
পারিবারিক অভাব অনটনের কারণে শিশুরা লেখাপড়া বাদ দিয়ে যুক্ত হয় ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে। একই কারণে কিশোরীরা বাল্যবিবাহের স্বীকার হয়। দারিদ্র্য দূর করতে নিজ গ্রাম ছেড়ে অনেক পরিবার সন্তানাদিসহ পোষাক শ্রমিকের কাজ করেন। তারা ঢাকা,গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ মুন্সিগঞ্জ সহ ঢাকার আশপাশের জেলায় বাস করেন। খুপরি ঘর ভাড়া নিয়ে এক বা দুই রুমের বাসায় গাদাগাদি করে বছরের পর বছর পার করেন। পরিবারের নারী পুরুষ সবাই একই কাজ করেন।
হাওর পাড়ের যুবকরা চট্টগ্রামে বিভিন্ন জেলায় কৃষিকাজ করতে যান। গ্রামের ভাষায় যাকে বলা হয় উজানে গেছে । বছর দশেক আগে হাওর এলাকার যুবকের কর্মসংস্থানের প্রধানকেন্দ্র ছিলো ভোলাগঞ্জ পাথর কোয়ারি। পরিবেশ রক্ষার দোহাই দিয়ে এখন পাথর উত্তোলন বন্ধ। তাই তারা আর যায় না।
বেকারদের অনেকেই আষাঢ় মাস থেকে আশ্বিন মাস দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করেন। তাদের আয়-রোজগার দিয়ে বাড়ির সংসার চলে। যুবকরা নির্মাণ শ্রমিক,রাজমিস্ত্রী, যোগালো কামলা, ছাদ কামলা, ঢালাই কামলা, কৃষিশ্রমিক সহ বিভিন্ন পেশায় কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
এখানকার বেকার জনগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র একটি অংশ জৈষ্ঠ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত হাওর নদীতে মাছ ধরে সংসার চালান । বর্ষায় কাজ থাকে প্রবীণ জনগোষ্ঠী অবসর সময়ে তাস,দাবা ষোলগুটি, নারী ও কিশোরী লুডু, সাপ লডু কড়ি, দশপচিশ, খুতখুত, রশিলাফ, কিশোররা দলবেধে মার্বেল খেলে সময় কাটায়। পুরুষ ও যুবকরা হাটবাজার করা সহ পারিবারিক কাজে ব্যস্ত থাকেন। প্রবীণরা কার্তিক মাস থেকে জৈষ্ঠ মাসে তারা বীজতলা, ক্ষেতরোয়া আগাছা পরিষ্কার করা ধান কাটা সহ কৃষি রিলেটেড বিভিন্ন কাজ করে থাকেন।
হাওর এলাকার ক্ষুদ্র প্রান্তিক মাঝারি শ্রেণির কৃষকরা বৈশাখ থেকে আষাঢ় মাস সুখে শান্তিতে কাটালেও বাকি ৯ মাস কাটে নানান অভাব অনটনের মধ্যে।
এই সরকারের তিন মেয়াদে হাওরাঞ্চলের মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থানের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা নেই। এছাড়া শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের সেবার গুণগত মান উন্নয়নে অবকাঠামো নির্মাণ ছাড়া আর কোন লক্ষ্য ছিলো না। সুষম খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলতে এবং অপুষ্টি দূর করতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।
প্রাথমিক শিক্ষা হলো শিশুর বুনিয়াদি শিক্ষা। শিশুদেখা শিক্ষা জীবনের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা হয় প্রাইমারি স্কুলে। এখানে সবচেয়ে মেধাবীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কম্পিউটার,গণিত ইংরেজি বিজ্ঞান ও ইন্টারনেট ব্যবহারে দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে।
শিক্ষিত অশিক্ষিত অর্ধ শিক্ষিত বেকার যুবক যুবতীদের কাজের ক্ষেত্র তৈরি করতে ব্যার্থ হয়েছে সরকার । সাগর অঞ্চলে মাছ কেন্দ্র করে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেছে অথচ হাওর এলাকায় তেমন কোন প্রতিষ্ঠান নেই।
প্রতিটি উপজেলায় একটি করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার উদ্যোগ নিলে বেকার সমস্যার সমাধান হতো। উত্তরাঞ্চলের মংগা দূর করেছে সরকার কিন্তু হাওরাঞ্চলের কার্তিক আর চৈত্র মাসের নিদান দূর করতে পারেনি সরকার । চৈত্র ও কার্তিক মাসে সুনামগঞ্জের গ্রামাঞ্চলে সিজনাল অভাব তীব্র হয়।

শিশুদের প্রাথমিক স্কুলে দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। কমপক্ষে সপ্তাহে ৫ দিন দুপুরে ডিম খিচুড়ি খাওয়ানোর প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন। এতে শিশুরা সুস্থ সবল হবে। ক্ষুধামুক্ত পরিবেশে তারা জ্ঞান অর্জন করতে পারবে। বেকার তরুণ তরুণী বৃত্তিমূলক কারিগরি প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বক্ষম ও সুদক্ষ শ্রমিক হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। স্বাবলম্বী করতে ঋণ দিয়ে উদ্যোগক্তা বানাতে হবে। তাদের উৎপাদিত পণ্য বিপননের জন্য বড়বড় শহর থেকে বিশ্বের যেকোনো দেশে অনলাইন বিপনন ব্যবস্থা চালু করতে হবে। যাতে তারা পণ্য বিক্রি করে লাভবান হতে পারেন। প্রতিটি ঘরে কর্মক্ষম নারী পুরুষকে প্রশিক্ষণ দিয়ে উদ্যোগক্তা হিসাবে গড়ে তুলতে হবে।
এলাকার প্রতিটি পরিবারের প্রাপ্ত বয়স্ক নারী পুরুষ কে কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে হবে। প্রতিটি বাড়ি জেন একটি ক্ষুদ্র কারখানা বা উৎপাদন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে ওঠে সে ব্যবস্থা করতে হবে।
যাতে পরিবারের নারী পুরুষ সবাই ক্ষুদ্র উদ্যোগক্তা হতে পারেন। প্রতিটি ইউনিয়নে কারাগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করতে হবে। এতে দিনের বেলায় নিয়মিত শিক্ষার্থী ও রাতের বেলায় কর্মক্ষম প্রবীন রা শিখার সুযোগ পান।
মানুষের জীবন মান উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট করতে হলে প্রতিটি মানুষের অর্থ উপাজর্নের যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষা স্বাস্থ্য সচেতনতা পুষ্টিকর খাবার সহ সব কিছুতে অর্থ প্রয়োজন। যতই সচেতন হন না কেন টাকা না থাকলে কোন কিছু করা সম্ভব না।
অবকাঠামো উন্নয়ন প্রয়োজন আছে তবে মানুষের জীবন মান উন্নত সমৃদ্ধ স্মার্ট করতে অগ্রাধিকার প্রকল্প গ্রহণ করা প্রয়োজন। যদি এমন হয় অবকাঠামো উন্নয়ন হলো রাস্তাঘাট মেডিকেল কলেজ অনেক কিছু হলো কিন্তু অর্থাভাবে বা যোগ্যতার অভাবে মানুষ এসব সুবিধা কাজে লাগাতে পারলো না। তাহলে এই উন্নয়ন দিয়ে কি হবে।
একজন জনপ্রতিনিধি গল্পের ছলে বলেছিলেন সুনামগঞ্জে অনেক অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হবে এসব প্রতিষ্ঠানের ক্যানটিনে সুনামগঞ্জের ছেলেরা চা, সিংগাড়া,চমুচা, ঝালমুড়ি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে আর অন্য জেলার ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হয় এতে সুনামগঞ্জবাসীর কি লাভ হবে ?
হাওরাঞ্চল বাদ দিয়ে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তোলা যাবে না। হাওরাঞ্চলকে ডিজিটাল করতে হবে পরে স্মার্ট করতে হবে। এজন্য দরকার বিচক্ষণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও যোগ্য নেতৃত্ব। আগামী নির্বাচনে চোখ কান খোলা রেখে যোগ্যজনকে মনোনয়ন দিতে হবে। কোন ভেজাল চলবে না।
লেখক হিমাদ্রি শেখর ভদ্র : স্টাফ রিপোর্টার সময় টেলিভিশন। সুনামগঞ্জ রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক।


সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন