হুমকির মুখে কীর্তনখোলা নদীর জীববৈচিত্র্য
- আপডেট সময় : ০৬:১৪:৫০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ জানুয়ারী ২০২৩
- / ৬৭
রানা সেরনিয়াবাত, বরিশাল:
কীর্তনখোলা নদীর নাব্যতা ফেরাতে চলছে ড্রেজিং বা খনন কাজ। কিন্তু প্রতি বারো মিনিট পরপর আটকে যাচ্ছে ড্রেজার এবং ঘন্টা সময় ধরে পলিথিন ও প্লাস্টিকজাতীয় বর্জ্য অপসারণ করতে হচ্ছে ড্রেজারের লস্করদের। এতে ব্যাহত হচ্ছে কাজের অগ্রগতি। লঞ্চ-স্টিমার ও নৌযানসহ নগরীর ড্রেন থেকে নির্গত পলিথিন ও প্লাস্টিকজাতীয় বর্জ্যে অনেকটাই ভাগারখানায় পরিণত হয়েছে কীর্তনখোলা নদী।
আর এতে করে লঞ্চ চলাচলে বিঘ্ন ঘটার পাশাপাশি হুমকিতে পড়ছে নদীর জীববৈচিত্র্য। বিশেষজ্ঞদের মতে এ অবস্থা চলতে থাকলে অচিরেই কীর্তনখোলা নদীতে আর কোনো মাছের অস্তিত্ব থাকবে না। একইসাথে পানি দূষনের কারণে বিপর্যস্থ হবে নগরীর পরিবেশও।
সরেজমিনে সোমবার বরিশাল নৌ-বন্দরে গিয়ে দেখা গেছে পলিথিন, প্লাস্টিকের বিভিন্ন ব্যাগ, ছেড়া জালসহ বহুবিধ ময়লা আবর্জনার স্তুপে ড্রেজার সুরমার ড্রেজিং মেশিন আটকে যাওয়ার দৃশ্য। নৌকা নিয়ে তিন-চার জন শ্রমিক কাচি দিয়ে কেটে কেটে সেই মেশিন পরিষ্কার করে নৌকা বোঝাই হলে ময়লাগুলো নিয়ে ফেলছেন সদর উপজেলার চরকাউয়ায় তৈরি বিআইডব্লিউটিএ এর নিজস্ব ভাগারখানায়।
ড্রেজারের চীফ মাষ্টার মো. রফিকুল ইসলাম জানালেন, প্রতি বারো মিনিট পরপর মেশিন থামিয়ে এভাবেই পরিষ্কার করতে হচ্ছে। ঘন্টার বেশি সময় লাগছে এই মেশিন থেকে এসব আবর্জনা পরিষ্কার করতে। এতে করে তিনদিনের কাজ ১২ দিনেও শেষ হচ্ছে না। রফিক আরো জানান, বেশিরভাগ ময়লাই পলিথিন ও প্লাস্টিকের বিভিন্ন বস্তু। এগুলো পচনশীল না হওয়ার কারণে নদীর ভিতরে জটপাকানো অবস্থায় পড়ে থাকে, এরসাথে পলিযুক্ত হয়ে আস্তরণ তৈরি করছে। নগরীর খালগুলো থেকেই বেশিরভাগ বর্জ্য এসে নদীতে পড়ছে বলে জানান তিনি।
জানা গেছে, বরিশাল নগরীরকে ঘীরে ২২ টি খাল ছিলো। এরমধ্যে বর্তমানে উল্লেখযোগ্য সাতটি খালই পুনঃ খনন জরুরী। নগরীর ড্রেনেজ ব্যবস্থাও এই সাতটি খাল ও নদীর সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়ার কারণে নগরীর সব বর্জ্য এসে নদীতে পরছে। আর এই প্লাস্টিক ও পলিথিন নগরবাসীর অসচেতনতার ফল বলে মনে করছেন বিআইডব্লিউটিএর নির্বাহী কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, গত ৪ ডিসেম্বর থেকে কীর্তনখোলা নদীতে নাব্যতা ফিরিয়ে আনার জন্য খনন কাজ শুরু হয়েছে। কিন্তু নদীতে এতোবেশী পলিথিন ও প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্য যে তা অপসারণ করা খুবই কষ্টকর। আর এ জন্য নগরবাসী ও বরিশাল সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের অসচেতনতাকেই দায়ী করেন তিনি।
তিনি বলেন, লঞ্চগুলো থেকেও যে নদীতে একেবারে কোনো বর্জ্য ফেলা হয় না একথা বলবোনা। তবে প্রতিটি লঞ্চেই বিআইডব্লিউটিএর নিজস্ব ময়লা ফেলার ডাম্প রাখা আছে। যাত্রীরা সেই ডাম্পে যেন ময়লা আবর্জনা ফেলে তা তদারকি করা হয়। তারপরও তা যথেষ্ট নয়। একইভাবে নগরীর ময়লা আবর্জনা নিয়ে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের সুদূর প্রসারী চিন্তা থাকা জরুরী।
বিআইডব্লিউটিএর বন্দর কর্মকর্তা আব্দুর রাজ্জাক আরো বলেন, ময়লা আবর্জনা জমে কীভাবে ড্রেজিং মেশিন আটকে যাচ্ছে এ দৃশ্য নগরবাসী ও নগরের খাল-নদী ও পরিবেশ নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের দেখা উচিত। পবা বা এ জাতীয় সংগঠনের বরিশালের নেতৃবৃন্দ এসে যদি স্বচক্ষে অবস্থা দেখেন তাহলে সমস্যার ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারবেন ও নগরবাসীর সামনে তা তুলে ধরতে পারবেন।
এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএর ড্রেজিং বিষয়ক তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মিজানুর রহমান বলেন, আমরা এ নিয়ে বরিশাল সিটি করপোরেশনের সাথে মিটিং করেছিলাম। সেখানে নগরীর খালগুলোকে এসব প্লাস্টিকজাত বর্জ্য মুক্ত রাখার বেশকিছু প্রস্তাবণা দেয়া হয়েছিল। সেটার বাস্তবায়ন হলে আজ নদীর এই অবস্থা হতো না। আমিতো বলবো বরিশাল সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষের উদাসীনতাই কীর্তনখোলা নদীর জন্য প্রধান হুমকী এখন।
এই মুহূর্তে বরিশাল নৌ বন্দরের ছোট লঞ্চঘাট এলাকায় আটকে আছে ড্রেজিং মেশিন। এখানে ভোলা গামী লঞ্চ এমভি সায়মার চালক নান্না বললেন, এই ময়লার কারণে ছোট লঞ্চই ঘাটে ভেড়াতে সমস্যা হচ্ছে, সেখানে বড় লঞ্চ এর কি অবস্থা ভাবুন। কখনো কখনো লঞ্চের পাখা আটকে যাচ্ছে এই ময়লায়।
আর এ্যডভেঞ্চার ৯ লঞ্চের মাষ্টার আলমাস দেওয়ান বলেন, শীতের সময়ে এমনিতেই সব নদীতে নাব্যতা কম থাকে। নদী শাসনের এটাই উপযুক্ত সময়। কিন্তু এটা পরিকল্পিত হওয়া উচিত। প্রতিবছর এই ড্রেজিং হয়। মাস দুয়েক ঠিক থাকে, তারপর আবারও একই অবস্থা। এর স্থায়ী সমাধান হওয়া উচিত। প্রতিবার ড্রেজিং এ কত টাকার ক্ষতি হয় ভাবা উচিত।
বরিশালের পবা, রান নদী ও পরিবেশ উন্নয়ন সংস্থার পরিচালক ও গবেষক রফিকুল আলম ছুটে এসে নিজ চোখে ময়লা- আবর্জনার স্তুপে আটকে থাকা ড্রেজিং মেশিন দেখে প্রথমে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তারপর উদ্বেগ উৎকন্ঠা নিয়ে বলেন, শেষ। এবার বুঝি কীর্তনখোলাাও ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর মতোই হবে। দ্রুত এ অবস্থা ঠেকানো না গেলে জীববৈচিত্র্যই শুধু নয়, দু একবছরে মাছ শূন্য হয়ে যাবে কীর্তনখোলা নদী।
রফিকুল আলম আরো বলেন, এভাবে ড্রেজিং এর আগে ওয়াটার ক্যামেরা ব্যবহার করে আগে নদীর এসব ময়লা পরিষ্কার করা জরুরী। তা না হলে এ ড্রেজিং কোনো কাজে আসবে না। তিনি এসময় নগরীর রসুলপুর এলাকায় জেগে ওঠা দৃশ্যমান চর গভীরভাবে কেটে চরকাউয়া অংশের ভাঙন ঠেকানোর পরামর্শ দেন।
কীর্তনখোলা নদীর এই বিপর্যস্ত অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন বরিশাল ৫ আসনের সংসদ সদস্য পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী কর্ণেল অবঃ জাহিদ ফারুক শামীম বলেন, নগরীর সাতটি খাল পুনঃখনন ও পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা সুসংহত করতে বেশ কয়েকবার উদ্যোগ নিয়েও তা সম্পন্ন করতে পারিনি। আমি আশাবাদী পরিস্থিতির বিবেচনায় কীর্তনখোলা নদী বাঁচাতে সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ সচেতন হবেন। এজন্য প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা দিতেও আমি প্রস্তুত রয়েছি।