রাজধানী’সহ সারাদেশের ফার্মেসি গুলোতে ভেজাল ওষুধের সয়লাব
- আপডেট সময় : ০৫:৪১:৩০ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৩
- / ৬৫
মো. আব্দুস সালাম
রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের ফার্মেসিগুলোতে নকল ও ভেজাল ঔষধ বিক্রি হচ্ছে। এসব ঔষধ খেয়ে রোগী সুস্থ্য হওয়ার পরিবর্তে আরও রোগাক্রান্ত হচ্ছেন। অনেক সময় রোগিকে মৃত্যুর মুখোমুখিও হতে হচ্ছে। সারাদেশে ভেজাল ঔষধ বিক্রি বন্ধে তেমন কোনো কার্যকর উদ্যোগ না থাকায় এর পরিধি আরও বাড়ছে। ভেজাল ঔষধ বিক্রি বন্ধে আইন প্রয়োগ, কঠিন শাস্তির ব্যবস্থাসহ কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও গবেষকরা বলছেন, ভেজাল বা নকল ঔষধের কারণে শরীরে ভয়াবহ রোগ দানা বাঁধে। লিভার, কিডনি, হার্ট, ব্রেন থেকে শুরু করে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এজন্য ভেজাল কারবারীদের বিরুদ্ধে কঠিন ব্যবস্থা নিতে হবে। যেন তারা ঔষধ ভেজালের সঙ্গে জড়ানোর সাহস না পান। অন্যদিকে মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়াতেও সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।
বিশ্ববাজারে বাংলাদেশি ঔষধের সুনাম ও চাহিদা বাড়লেও দেশের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। একদিকে ঔষধ শিল্পের অভাবনীয় উন্নতি, অন্যদিকে দেশের বাজার নকল বা ভেজাল ঔষধে ছেয়ে গেছে। সারাদেশে ভেজাল ও নিন্মমানের ঔষধের কারণে মানুষের জীবন হুমকির মুখে। নকল, ভেজাল ও নিম্নমানের ঔষধ উৎপাদন ও বিপণন কেনো নিয়ন্ত্রণে আসছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
ফার্মেসিতে কর্মরতদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের বাজারে অ্যালোপ্যাথিক থেকে শুরু করে আয়ুর্বেদিক ও হারবাল সব ধরনের ঔষধই নকল হচ্ছে। এসব ঔষধ খেয়ে লিভার, কিডনি বিকল, বিকলাঙ্গ, মস্তিষ্কের জটিলতাসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগে মৃত্যু বাড়ছে। তাই মানুষকে সচেতন হতে হবে, তারা যেন ভেজাল ঔষধ না কেনেন। অন্যদিকে কর্তৃপক্ষেরও সেই ব্যবস্থা করা দরকার, যাতে করে কোথাও ভেজাল ঔষধ বিক্রি না হয়।
খুচরা ঔষধ বিক্রেতারা জানান, অধিক লাভের আশায় তারা নকল ঔষধ বিক্রি করেন। আর এসব ঔষধ বিক্রি করতে গিয়ে ধরা পড়লে, কারাগারে গেলে তাদের ছাড়ানোর ব্যবস্থাও করে ভেজাল ব্যবসায়ীরা। মূলত বহুল ব্যবহৃত, বড় ও নামি কোম্পানির ঔষধ নকল করা হয়ে থাকে। তবে দোকানিরা সবাইকে এসব ঔষধ দেয় না। যারা ঔষধ সম্পর্কে বোঝে না, তাদের দেওয়া হয়। এসব ঔষধ গ্রামে বেশি চলে।
একজন খুচরা ঔষধ বিক্রেতার সাথে এ নিয়ে কথা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই বিক্রেতা বলেন, সারাদেশে বিশেষ করে নামি-দামি কোম্পানিগুলোর ওষুধের অনেক চাহিদা। বিষয়টিকে পুঁজি করে কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা কেমিক্যাল কিনে নকল বা ভেজাল ঔষধ তৈরি করছে। পরে তা রাজধানীসহ সারাদেশে বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছে। অনেক খুচরা ঔষধ দোকানিরাও এসব বিক্রি করছেন। গ্রামে এসব ঔষধ বেশি বিক্রি হচ্ছে। সাধারণ মানুষ এটি বুঝতেই পারবেন না। আমরাই তো বুঝতে পারি না।
আপনার ফার্মেসিতে ভেজাল ঔষধ আছে কি না? এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, এখন আমার কাছে নেই। তবে অনেক দোকানেই থাকে, আপনাকে দিবে না। নিন্ম শ্রেণির মানুষদের দেওয়া হয়, যাদের এ বিষয়ে ধারণা নেই।
দেশের বাজারে ঔষধের সবচেয়ে বড় পাইকারি মার্কেট রাজধানীর মিটফোর্ড এলাকা। নিম্নমানের ও ভেজাল ঔষধ বিক্রির অন্যতম আখড়া হচ্ছে এই মিটফোর্ড এলাকা। এখান থেকেই সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে এসব ভেজাল ঔষধ ছড়াচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজধানীর মিটফোর্ডে খোলাবাজারে বিক্রি করা হয় ঔষধ তৈরির কাঁচামাল। নিয়ম হলো- ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদিত কোম্পানিই শুধু ঔষধ তৈরির কাঁচামাল আমদানি করতে পারে। অথচ ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল মহলের চোখের সামনেই এসব কাজ চলছে। বাজারে ভেজাল ও নিন্মমানের ঔষধের বিরুদ্ধে সরকারের ঔষধ অধিদপ্তরের অভিযান দেখা গেলেও এসব নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। মাঝে-মধ্যে ভ্রাম্যমান আদালতের অভিযানে নকল ও ভেজাল ঔষধ উদ্ধার, ঔষধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিল ও আটক করা হয়।
দেশের ঔষধ-বাণিজ্যের এই পরিস্থিতির জন্য সংঘবদ্ধ চক্র যুক্ত রয়েছে বলে জানা গেছে। এসব নিয়ে প্রয়োজনীয় মনিটরিং ও কার্যকর শাস্তির ব্যবস্থা না থাকায় ভেজালকারীরা এর পরিধি বাড়াচ্ছে। ভেজাল ও নকল ঔষধের কারণে রোগীরা সুস্থ হওয়ার বদলে আরও বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। এসব ঘটনায় প্রাণহানির সংখ্যাও কম নয়। কিন্তু এসব ঘটনায় দায়ীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা যাচ্ছে না।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নকল-ভেজাল ঔষধ উৎপাদন ও বিপণনে একাধিক চক্র সক্রিয় আছে। গত কয়েক বছরে মিটফোর্ডের বাজার থেকেই কয়েকশ কোটি টাকা মূল্যের ভেজাল ঔষধ জব্দ করা হয়েছে। এসব ভেজাল ঔষধ তৈরিতে ব্যবহার করা হয় আটা-ময়দা ও রং।
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, ভেজাল বা নকল ঔষধ উৎপাদনকারীরা সারাদেশের বিভিন্ন এলাকায় কারখানা বানায়। তবে তাদের পাইকারি বাজার রাজধানীর মিটফোর্ড। এই পাইকারি বাজার থেকেই ভেজাল ঔষধ ছড়ায় সারাদেশে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, বিশ্বে উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাজারে যে ঔষধ বিক্রি করা হয় তার ১৫ শতাংশ ঔষধই নিন্মমানের, ভেজাল বা নকল। কনজিউমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) এক প্রতিবেদন মতে, দেশে প্রতি বছর প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকার ভেজাল বা নিম্নমানের ঔষধ বিক্রি হয়। যা মোট ঔষধ বিক্রির প্রায় ২০ শতাংশ।
ভেজাল ঔষধ নিয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক জনাব মো. আইয়ুব হোসেনের সাথে কথা হয়। তিনি বলেন, নকল, ভেজাল ও চোরাকারবারিদের নিয়ে আমাদের মনিটরিং আছে। আমরা নিয়মিত মিডফোর্ডে অভিযানে যাচ্ছি। গত পরশু মিডফোর্ডে অভিযান পরিচালনা করে কিছু নকল ঔষধসহ ধরা হয়েছে। আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আমরা বসে নেই।
মো. আইয়ুব হোসেন বলেন, এসব ভেজালকারীদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়। মাঝে-মধ্যে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জেল-জরিমানা করা হয়। আমাদের প্রধান কার্যালয় থেকে মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা আছে, মাসিক সমন্বয় সভায় পারফরমেন্স দেখা হয়। এসব নিয়ে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঔষধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক অ.ব.ম ফারুক বলেন, এসব ভেজাল বা নকল ঔষধ দেশের আনাচে-কানাচে যাচ্ছে। রাজধানীতে ভেজাল ঔষধ তুলনামূলক কম। ভেজাল ঔষধের প্রভাব বেশি আমাদের গ্রাম বা নির্জন এলাকাগুলোতে। রাজধানী থেকে দূরে বা আইনশৃংখলা বাহিনী থেকে দূরে তারা এসব ভেজাল ঔষধ ছড়িয়ে দেয়।
তিনি বলেন, ভেজাল ঔষধের বিরুদ্ধে অনেক কিছু করা দরকার সেগুলো তো আলোচনার বিষয় না। কিন্তু ক্ষতিটা হলো মানুষ অসুস্থ অবস্থায় ঔষধ খায়। তখন যদি সে সঠিক ঔষধ না খায় তাহলে তার দ্বিগুণ ক্ষতি। শরীরের বিভিন্ন অর্গানগুলো যেমন, লিভার, কিডনি, হার্ট খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ভেজাল ঔষধের কারণে সুস্থ না হয়ে নতুন করে শরীরে অসুখ তৈরি হচ্ছে।
অধ্যাপক অ.ব.ম ফারুক আরও বলেন, মানুষকে সচেতন হওয়া দরকার তারা যেন ভেজাল ঔষধ না কেনেন। মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে সরকারকে বিভিন্ন উদ্যোগ নিতে হবে। ঔষধ যে ভেজাল হয়, গ্রামের অনেক মানুষ তা জানেই না। আবার জানলেও তো চিনে না কোনটা আসল আর কোনটা ভেজাল ঔষধ।
একই সঙ্গে বাজারে যেন ভেজাল ঔষধ না পাওয়া যায়, সেই ব্যবস্থা করতে হবে বলে মনে করেন আ.ব.ম ফারুক। তিনি বলেন, ঔষধ নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষ ও আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যৌথভাবে এই কাজটা করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ বিবার্তাকে বলেন, ভেজাল ঔষধ নিয়ে অল্প করে কথা বলা মুশকিল। ভেজাল ঔষধের কারণে মানুষের লিভার, কিডনি, হার্ট, ব্রেন সবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে গর্ভবতী মা ও ছোট বাচ্চাদের বেশি ক্ষতি হয়। রক্ত শূন্যতা দেখা দেয়, কোনো ধরনের খাবার খেতে পারে না। কারণ রুচি থাকে না।
ভেজাল ঔষধ যারা তৈরি করে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে বলে মনে করেন অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, তারা কিভাবে এসব অনৈতিক কাজ করছে তা তদন্ত করতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে কঠিন আইন করতে হবে। কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। আবার শুধু আইন করলেই বা আইন থাকলেই হবে না। আইন যাতে কার্যকরী হয়, তারও যথাযথ ব্যবস্থাও গ্রহন করতে হবে।