মাটি মামুন:
কৃষিতে সমৃদ্ধ হচ্ছে উত্তরাঞ্চল বাড়ছে নতুন নতুন আবাদ উন্নয়নের ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে উত্তর জনপদ সমৃদ্ধ হচ্ছে নদ-নদীতে ভরা উত্তরের কৃষি। বন্যা ও খরাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘুরে দাঁড়াতে শিখেছে এখানকার কৃষিনির্ভর পরিবারগুলো। এতে বদলে যাচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি। কৃষিতে বাড়ছে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার। উন্নয়ন বিশ্লেষকরা বলছেন, কৃষিভিত্তিক পরামর্শ ও গবেষণায় গ্রামীণ অর্থনীতিতে পরিবর্তন এসেছে। সঙ্গে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পরামর্শ ও সেবায় লাভজনক ফসল উৎপাদনে ঝুঁকছেন কৃষকরা।
কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, নীলফামারী, লালমনিরহাটসহ রংপুর অঞ্চলের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি শস্য উৎপাদন। রংপুর বিভাগের আট জেলায় রয়েছে অসংখ্য নদী, নালা, খাল, বিল ও চরাঞ্চল। একসময় প্রায় প্রতিবছর বন্যা, খরা ও প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হতেন কৃষকরা। যার প্রভাবে বছরের বেশিরভাগ সময় চাষাবাদ বিঘ্ন হত। কাজ থাকত না, পড়ে থাকত আবাদি জমি। ফলে এ অঞ্চলের কিছু জেলা ছিল মঙ্গাপীড়িত। কিন্তু গত দুই দশকে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, আধুনিক কৃষি সম্প্রসারণ, কৃষি ও কৃষকের উন্নয়নে সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসায় বদলে যেতে শুরু করেছে এসব জেলার মানুষের ভাগ্য। এখন নদ-নদী, খাল, বিল, অনাবাদি জমির ব্যবহার বেড়েছে। সময়োপযোগী চাষাবাদে বাড়ছে কৃষকের আগ্রহ। আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন রংপুর বিভাগের বেশিরভাগ জেলায় ফুলকপি, বাঁধাকপি, মুলা, আলু, বেগুন, করলা, বাদাম, সরিষা, সূর্যমুখী, গাজর ও ভুট্টা চাষাবাদ বেড়েছে। ধান, গম, পাটের পাশাপাশি কমলা, কফি, চা-পাতা, সুপারফুড চিয়া-কিনোয়া, পেরিলা চাষে খুলেছে সম্ভাবনার দুয়ার।
এসব জেলার কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে কৃষকরা উন্নতির দিকে হাঁটছেন। কৃষি বিভাগের পরামর্শ ও নিয়মিত যোগাযোগের কারণে সমৃদ্ধি অর্জন করেছেন কৃষকরা। সরকারের পাশাপাশি এগিয়ে এসেছে বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও। সংগঠনগুলো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কৃষকদের তথ্যপ্রযুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত করে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। পাশাপাশি লাভজনক ফসলের বীজ ও চারাও বিতরণ করছে। এছাড়া, কোন ফসল চাষে কৃষকরা বেশি লাভবান হতে পারবেন সেই বিষয়েও গবেষণা চালিয়ে আসছে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলতি মৌসুমে লালমনিরহাটের পাঁচটি উপজেলায় ২ হাজার ৪১০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে। ফুলকপি, বাধাঁকপি, মুলাসহ শাকসবজিআবাদ হয়েছে ৪ হাজার ৮২০ হেক্টর জমিতে। পেঁয়াজ বপন করা হয়েছে ৩৭০ হেক্টর জমিতে। এবার জেলায় ভুট্টার ফলনও ভালো হয়েছে। মোট ১১ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে ভুট্টা আবাদ করা হয়েছে।
রংপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে রংপুর জেলায় ১৮ হাজার ৮৬৫ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে ৫২ হাজার ৬৮০ হেক্টর জমিতে।এর মধ্যে দেশি জাতের আলু ৮৮ হাজার ৭৪৫ এবং উফশী জাতের আলু ১৪ লাখ ৬ হাজার ৪৭ মেট্রিক টন উৎপাদন হয়েছে। এবার রংপুরে ৫২ হাজার ৬৮০ হেক্টর জমিতে ভুট্টার আবাদ হয়েছে। যা গত বছরের তুলনায় অনেক বেশি। এদিকে, ১ হাজার ২০০ কৃষককে রপ্তানি উপযোগী আলু চাষে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে।
অন্যদিকে কয়েক বছর ধরে রংপুরে চাষ করা হচ্ছে কফি। জেলার তারাগঞ্জের মোখলেছুর রহমান মাত্র ৫ বছরে কফি চাষ করে আয় করছেন লাখ লাখ টাকা। বাংলাদেশে কফি চাষ হচ্ছে বিষয়টি অনলাইনে জানতে পেরে উদ্বুদ্ধ হন মোখলেছুর রহমান। এরপর শখ করে কফি চাষ শুরু করেন। ২০১৭ সালে বাড়ির পাশে ২০ শতক জমিতে ৪৫০টি চারা রোপণের মধ্য দিয়ে কফি চাষ শুরু তার। সেসময় তার খরচ হয় ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা।
মোখলেছুর রহমান কফি বাগানের পাশাপাশি বাণিজ্যিকভাবে চারা তৈরি শুরু করেন। এ বছর প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকার চারা বিক্রি করেছেন তিনি। নার্সারিতে আরও চারা রয়েছে। সেগুলো বিক্রি হলে সব মিলিয়ে এবার প্রায় ৮ লাখ টাকার চারা বিক্রি হবে। তার উদ্যোগে ইতোমধ্যে ঠাকুরগাঁও, নওগাঁ, বগুড়া, রাজশাহী, খুলনা, ফেনীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ছোটবড় ৫২টি কফি বাগানে কফি চাষ হচ্ছে। সেখানে প্রায় ১৭ হাজার কফি গাছ রয়েছে। তারাগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা উর্মি তাবাসসুম বলেন, আমরা চেষ্টা করেছি সব ধরনের সহযোগিতা করার। সরকারিভাবে রংপুর জেলার দুটি উপজেলায় কফি চাষ শুরু হয়েছে। তবে তারাগঞ্জে এখনো সরকারিভাবে শুরু হয়নি। মোখলেছুর রহমানের কফি বাগান থেকে কেউ উদ্বুদ্ধ হয়ে বাগান করতে চাইলে উপজেলা কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহায়তা করা হবে।
আবহাওয়া অনুকূলে থাকাসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন পরামর্শ ও সহযোগিতার কারণে এবার রংপুর অঞ্চলে আমন আবাদে খুশি কৃষকরা। চলতি মৌসুমে এ অঞ্চলে প্রায় ১ লাখ টন বেশি আমন চাল উৎপাদন হয়েছে।
২০২১-২২ আমন মৌসুমে ৬ লাখ ১৪ হাজার ২৯৫ হেক্টর জমিতে চালের উৎপাদন হয়েছিল ১৭ লাখ ৬৫ হাজার ৬০০ টন। রংপুর আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রংপুর অঞ্চলে আমন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ লাখ ১৫ হাজার ৬৮৫ হেক্টর। চাল উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৮ লাখ ৭ হাজার ৯১৬ টন। তবে অর্জিত জমির পরিমাণ হচ্ছে ৬ লাখ ১৫ হাজার ৯৮১ হেক্টর। এর মধ্যে রংপুর জেলায় চাল উৎপাদন হয়েছে ৫ লাখ ২ হাজার ৩৩৬ টন, গাইবান্ধায় ৩ লাখ ৭৭ হাজার ১৫৪ টন, কুড়িগ্রামে ৩ লাখ ৬৯ হাজার ৯৪৬ টন, লালমনিরহাটে ২ লাখ ৬৩ হাজার ৩৭২ টন ও নীলফামারীতে ৩ লাখ ৫০ হাজার ৬৯০ টন।
নীলফামারী জেলার কৃষক আব্দুল মোত্তলেব বলেন, উন্নত বিশ্বে কৃষি ব্যবস্থা আধুনিক করার কারণে আমাদের চাষাবাদে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। কৃষিকাজে আধুনিক যন্ত্র আসায় একদিকে যেমন চাষাবাদ বেশ সাশ্রয়ী হচ্ছে তেমনি ফলনও বেশি পাচ্ছি।
নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার মাগুরা মাস্টারপাড়া এলাকার কৃষক শাহজাহান মিয়া। গত মৌসুমে উপজেলা কৃষি অফিসের পরামর্শ নিয়ে ও বীজ সংগ্রহ করে ৩০ শতাংশ জমিতে ভেষজ গুণসমৃদ্ধ ফসল পেরিলার পরীক্ষামূলক চাষ ও ঘানিতে তেল উৎপাদন করে সফলতা পেয়েছেন। প্রথম বছর আশানুরূপ ফলন ও অর্থনৈতিক সাফল্য পাওয়ায় চলতি বছর ৪৫ শতাংশ জমিতে চাষাবাদ করেছেন। নতুন এই ফসল চাষে আগ্রহ দেখছেন স্থানীয় কৃষকরাও। তারা স্বপ্ন দেখছেন বাণিজ্যিকভাবে পেরিলা চাষের। পানি জমে না এমন উঁচু জমিতে পেরিলার ফলন ভালো হয়। ভেষজ গুণসমৃদ্ধ এই ফসল চাষে বেলে-দোআঁশ ও দোআঁশ মাটি বেশি উপযোগী। উচ্চ গুণাগুণসম্পন্ন ও উচ্চ মূল্যের একটি ভোজ্যতেল জাতীয় ফসল পেরিলা। আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি লিটার ২১০০ থেকে ২৫০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। এর তেল হৃদযন্ত্র, মস্তিস্ক, ত্বক ও ডায়াবেটিস প্রতিরোধ, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও দৃষ্টিশক্তি বাড়ায়। এছাড়া হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ এবং ঝুঁকিও কমায়। কৃষক শাহজাহান মিয়া অপ্রচলিত ফসল চাষে আগ্রহী।
তিনি উপজেলায় সমতল জমিতে চা, কফি ও আগর চাষে সফলতা পেয়েছেন। বর্তমানে মেক্সিকোর চিয়া ও কিনোয়া চাষেও সফলতা পেয়েছেন। তাছাড়া বর্তমানে কমলা, বিষমুক্ত বেগুনসহ অন্যান্য ফসল চাষ করছেন।
লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার বড়াবাড়ি গ্রামের চাষি মনসুর আলী বলেন, আমাদের এখানে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি ব্র্যাক ও আরডিআরএসও পরামর্শ দেয়। তাদের পরামর্শ ও সার্বিক সহযোগিতায় আমি আগাম জাতের আলু চাষ করি।
২৫ শতাংশ জমিতে আলুর চাষ করতে আমার ১০ হাজার টাকা খরচ হলেও এখন পর্যন্ত বিক্রি হয়েছে ৫০ হাজার টাকা। আরও ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা বিক্রি করা যাবে।
নীলফামারীর উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা মো. ইমরান বলেন, কৃষকরা সব ধরনের ফসলই চাষ করছেন। প্রতিবছরই ভালো ফলন হচ্ছে। এর কারণ সরকার কৃষকদের পাশে রয়েছে। তারা সব ধরনের সহযোগিতা দিচ্ছে। এক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও। কিন্তু যখন ফসলের বাম্পার ফলন হয় কিন্তু কৃষকরা দাম পান না তখন সমস্যা হয়।
রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. ওবায়দুর রহমান মন্ডল জানান, কৃষকদের সেবা দিতে মাঠ পর্যায়ে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা, জেলা ও উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারা নিরলসভাবে কৃষকদের সেবা ও পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমান সরকার কৃষির উন্নয়নে জোরালো ভূমিকা রাখছে, তার সুফল পাচ্ছি আমরা। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা কৃষকদের জন্য কাজ করছে, যা কৃষকদের জীবনমান উন্নয়নে সহায়ক।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও উন্নয়ন গবেষক ওমর ফারুক বলেন, উত্তরাঞ্চলে কলকারখানা না থাকা বা বিকল্প কর্মসংস্থানের সুযোগ কম থাকায় এখানকার বেশিরভাগ মানুষই কৃষিনির্ভর।সরকারি-বেসরকারি গবেষণা, কৃষি সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ এবং চাষাবাদে নিত্যনতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন রংপুর অঞ্চলের কৃষি অনেকটাই সমৃদ্ধ।
তামাকের চাষাবাদ কমেছে, নতুন নতুন ফসল উৎপাদন বাড়ছে। বিশেষ করে হাঁড়িভাঙ্গা আম, কফি, চা-পাতা, সুপারফুড চিয়া-কিনোয়া, পেরিলাসহ অন্যান্য ফসলের চাষে উত্তরাঞ্চলে সম্ভাবনার দুয়ার খুলেছে।এখন সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী সার, বীজ, তেলসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সহজলভ্য করা গেলে এই অঞ্চল সারা বছরই কৃষিতে এগিয়ে থাকবে। এজন্য এই জনপদে কৃষিভিত্তিক অর্থনৈতিক জোন প্রতিষ্ঠাতা করতে হবে।
এসকে মাল্টিমিডিয়া থেকে প্রকাশিত "প্রতিদিনের নিউজ ডটকম" হেড অফিস: ৫৩/এ নয়া পল্টন এক্সটেনশন রোড ঢাকা-১২০০। মোবাইল ০১৯৩০ ১৭২ ৫২০, ০১৩১৪ ১৬৮ ৬৪৪ । আঞ্চলিক অফিস: হাজী রজ্জব আলী সুপার মার্কেট (নিচ তলা) চিটাগাংরোড, সিদ্ধিরগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ। Email:protidinernews24@gmail
সাবধান
এই পৃষ্ঠার বিষয়বস্তু কপি করতে পারবেন না