গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর ছিলেন প্রকৃতি প্রেমিক, শিক্ষা অনুরাগী ও সমাজসেবক
- আপডেট সময় : ০৯:২৩:২৯ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২২
- / ৬২
এ কে আজাদ,ময়মনসিংহ:
প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ, লেখক, প্রকৃতি প্রেমিক, শিক্ষা অনুরাগী, সমাজসেবক ও দানবীর গৌরীপুর রাজবাড়ির পঞ্চম জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর ৬৫তম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল ২৯ নভেম্বর। তার ৬৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এক সপ্তাহব্যাপী স্মরণসভার আয়োজনসহ ইতিবৃত্ত গবেষণা ও বিভিন্ন অনুসন্ধানী কাজ সম্পন্ন করেছে ময়মনসিংহের গৌরীপুরস্থ এসিক এসোসিয়েশন, ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন এবং দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স। ঐতিহাসিক নিদর্শন, স্থাপত্য, পুরাকীর্তি, প্রাচীন মানচিত্র, প্রাচীন বই, শ্রুতি, স্মৃতি, দলিল-দস্তাবেজ, প্রাচীন শিলালিপি, ইটের ধরণ, ভাঙ্কর্য ও লিপিবদ্ধ বিবরণ ইত্যাদির অনেক বিষয় লুকিয়ে আছে গৌরীপুরের প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাসে। লুকিয়ে থাকা প্রাচীন সভ্যতাকে ময়মনসিহের গৌরীপুরে অবস্থিত একটি গবেষণা কেন্দ্র ও অনুসন্ধানী সংগঠনগুলো আমাদের জনসম্মুখে হাজির করেছে । শুধুমাত্র এই একটি কারণে সংগঠনগুলো আমাদের কাছে অমর হয়ে থাকবে।ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর ৬৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে তার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শেকড় সন্ধানী তথ্য ধারাবাহিকভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে এবং করা হবে। গৌরীপুরে তার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে স্মরণসভাটি ছিল বাংলাদেশে প্রথম কোনো আয়োজন। ইতিহাসের সত্যানুসন্ধান কাজে ব্রজেন্দ্র কিশোরের মৃত্যুর তারিখ এই প্রথম বাংলাদেশে তার প্রতিষ্ঠিত তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জানানো হয়। ১৯৫৭ সালের ২৯ নভেম্বর তার মৃত্যু হয়। সোমবার সন্ধায় (৫ ডিসেম্বর, ২০২২) এক প্রতিবেদনে বিষয়টি জানানো হয় যে, ব্রজেন্দ্র কিশোর অনেক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংস্থা ও সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ক্রীড়াজগতের সঙ্গেও তিনি জড়িত ছিলেন। স্বভাবত তিনি ছিলেন মেধাবী, উচ্চমনা ও প্রতিভাশালী। তিনি সঙ্গীত শাস্ত্রে বিশেষ অনুুরাগী ছিলেন। তিনি একজন নাট্যশিল্পী হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘রাজা’ উপাধি দিতে প্রস্তাব করলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। প্রখ্যাত যন্ত্রসঙ্গীতশিল্পী বীরেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী তাঁর পুত্র। জানা যায়, মোমেনসিং ও জাফরশাহী পরগানার জায়গীরদার, গৌরীপুরের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদারদের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী বংশের ষষ্ঠ পুরুষ ও গৌরীপুর রাজবাড়ির চতুর্থ জমিদার রাজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ১৮৭৩ খ্রি. (বাংলা ১২৮০ সালে) ২৪ বছর বয়সে নবীন যৌবনে মৃত্যুবরণ করেন। পরবর্তীতে জমিদারী পরিচালনা বা পতির জলপিন্ড সংস্থানের জন্য প্রয়াত রাজেন্দ্র কিশোরের সহধর্মিণী বিশ্বেশ্বরী দেবী ১৮৭৭ খ্রি. (বাংলা ১২৮৪ সালে) রাজশাহীর বালিহার গ্রাম নিবাসী হরিপ্রসাদ ভট্টাচার্যের পুত্র ব্রজেন্দ্র কিশোরকে দত্তক পুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন।১২৮১ বঙ্গাব্দের ২৯ বৈশাখ/বাংলাদেশে ২৮ বৈশাখ (ইংরেজি ১২ মে, ১৮৭৪ সালে) রাজশাহী বিভাগের নওগাঁ জেলার বালিহার গ্রামে তাঁর জন্ম। ইতিহাস বলছে, এক সময় বিশ্বেশ্বরী দেবীর পতি রাজেন্দ্র কিশোরের অসুস্থ শরীর ও উদাসীনতা সময়ে তিনি স্বহস্তে জমিদারির দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিশ্বেশ্বরী দেবী ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে ময়মনসিংহ সদর চিকিৎসালয়ের সাহায্যকল্পে ১৫ হাজার টাকা দান করেন। ময়মনসিংহ সরকারি (জাতীয়) স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য এককালীন টাকা ও পতির নামে একটি মাসিক বৃত্তি প্রদান করে দানশীলতা পরিচয় দিয়েছেন। কিশোরগঞ্জে জাতীয় স্কুল ও মাসিক সাহায্য প্রদান করেছিলেন। তাছাড়া তার প্রবর্তিত নিয়ম অনুসারে প্রতিবছর অষ্টমী উপলক্ষে বিভিন্ন পরগনা অঞ্চলের বহু সংখ্যক যাত্রী গৌরীপুরে তিন দিনব্যাপী খাবারের ব্যবস্থা করা হতো।
গৌরীপুর রাজবাড়ির পঞ্চম জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী একজন প্রকৃতি প্রেমিক ও জ্ঞানান্বেষী ছিলেন। বাংলার ছয় ঋতুর মধ্যে প্রতিটি ঋতুর রয়েছে আলাদা আলাদা সৌন্দর্য। তাই ঋতু নামের সাথে মিল রেখে তার দুই মেয়ের নাম রাখা হয়েছিল হেমন্তবালা ও বসন্তবালা। তার আমলেই নির্মিত হয়েছিল বোটানিক্যাল গার্ডেন, দু’টি বিখ্যাত বাংলো ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ইতিহাসের সত্যানুসন্ধান একটি কঠিন কাজ এবং দুরূহ দায়িত্ব। সে সময়ের ইতিহাসের তথ্যগুলোকে গবেষকদের শ্রম ও নিষ্ঠা দিয়ে চয়ন করা হয়েছে ৷ গৌরীপুর ও অন্যান্য স্থানের অত্যন্ত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে তাদের নিজস্ব সত্য ও তথ্যের আলোকে আলোকিত করা হয়েছে। জরিপ ও এক যুগ ধরে লুকিয়ে থাকা ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহ ও তথ্য গবেষণা করে জনসম্মুখে হাজির করা হয়।
গৌরীপুর শহরে একটি বোটানিক্যাল গার্ডেন স্থাপন:
ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী গৌরীপুরের মধ্যশহরে অবস্থিত রাজপ্রাসাদ প্রাঙ্গনের চারদিকে দেড়শ বিঘা (৪৯.৫ একর) জমির উপর একটি বোটানিক্যাল গার্ডেন স্থাপন করেন। বোটানিক্যাল গার্ডেনের মধ্যে ছিল পামবীথি সড়ক, অনন্ত সাগর, গোলপুকুর, জোড়া পুকুর, বৃত্তাকার দ্বীপ, রানীর দীঘি, প্রাচীন দুর্গামন্দির, নাট্যমন্দির (বর্তমান ঝলমল সিনেমা হল), গৌরীপুর রাজেন্দ্র কিশোর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, জলসা ঘর, রেস্ট হাউজ, গেস্ট হাউজ বা অতিথিশালা (১ম, ২য়, ৩য় শ্রেণি), কাচারি ভবন, রাজপ্রাসাদ, যুগলকিশোর আমলের বৃক্ষরোপণের দেবদারু গাছসহ অনেক মূল্যবান ও দূর্লভ গাছগাছালি। এ ছাড়াও ছিল বটগাছ ও বিভিন্ন মূল্যবান ঔষধি গাছ।
১৯৪৭ সালের পর থেকে বোটানিক্যাল গার্ডেনটি বিভিন্ন খন্ডে বিভক্ত হতে থাকে। ইতিহাস বলছে, পাটবাজার মোড় হতে মধ্যবাাজার মোড় পর্যন্ত বাজার পশ্চিম লাইন, গৌরীপুর মহিলা অনার্স কলেজ, গৌরীপুর উপজেলা পরিষদ, গৌরীপুর রাজেন্দ্র কিশোর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, মুক্তমঞ্চ, বঙ্গবন্ধু চত্বর, শহীদ হারুন পার্ক, বড় মসজিদ, কালীখলা প্রাঙ্গন, পৌর ভূমি অফিস, কৃষি অফিস, জলসা ঘর, রেস্ট হাউজ, সিনেমা হল রোড, গোবিন্দবাড়ি মন্দির, রাজবাড়ি রোড ও রাজবাড়িসহ অনেক স্থাপত্য গার্ডেনের আওতায় ছিল।
উত্তরবাজারে ছিল শতবর্ষী রেইনট্রি গাছের সারি যা একটি বড় নদীবন্দরের দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করতো। কোনাপাড়া বা দূর হতে রেইনট্রি গাছের সারির দিকে তাকালে অনেকটা পাহাড়ের মতো দেখাতো । ধানমহাল নিবাসী অরুন ঘোষের সঙ্গে কথা হলে তিনি জানান, পাকিস্তান আমলে উপজেলার মূল ফটকটি যেখানে আছে, সেখানে ছিল না, উপজেলা বাউন্ডারি উত্তরের দেওয়াল ও পাশে রাস্তাটিও ছিল না। জোড়া পুকুরপাড়ে বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় মোড় হতে সিনেমা হল মোড় পর্যন্ত একটা মোটা দেওয়ালের বাউন্ডারি ছিল। তখন মূল ফটক ছিল বঙ্গবন্ধু চত্বরে। কাছারি ভবন অর্থাৎ বর্তমান প্রেস ক্লাবের সামনে ফুলের বাগান ছিল। এই বাউন্ডারির মধ্যে ছিল অনেক মূল্যবান ও দূর্লভ গাছগাছালি, তাছাড়া বিভিন্ন মূল্যবান ওষুধি গাছ এবং ফল ও ফুলের গাছ। তিনি আরো বলেন, আশির দশক পর্যন্ত উপজেলা পরিষদের বাউন্ডারি ‘বাগান’ নামে পরিচিত ছিল।
গৌরীপুর রাজেন্দ্র কিশোর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা:
গৌরীপুর রাজেন্দ্র কিশোর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় (সংক্ষেপে গৌরীপুর আর. কে. সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়) ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার একটি ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়। এর রয়েছে একশত বছরেরও অধিক সময়ের স্মরণীয় ও সুদীর্ঘ ইতিহাস। গৌরীপুর রাজপ্রাসাদ প্রাঙ্গনে একটি বোটানিক্যাল গার্ডেন স্থাপনের পর এখানে উন্নত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন তিনি। জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ১০ জুলাই ১৯১১ খ্রিঃ তাঁর পিতা প্রয়াত রাজেন্দ্র কিশোর চৌধুরীর নামানুসারে ১১ একর জমিতে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার সময় বিদ্যালয়ের নাম ছিল ‘দি রাজেন্দ্র কিশোর হাই স্কুল’। বিদ্যালয়টি ২৫ এপ্রিল, ১৯৯১ খ্রিঃ সরকারিকরণ হয়। তখন থেকে এই বিদ্যালয়ের নামের সাথে সরকারি যুক্ত করা হয়। উপজেলা সদরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বিশাল জায়গা জুড়ে, সুন্দর মনোমুগ্ধকর ও কোলাহলমুক্ত পরিবেশে গড়ে ওঠেছে প্রাচীনতম, মানসন্মত ও ঐতিহ্যবাহী এই বিদ্যাপীঠ। স্কুল ক্যাম্পাসে সাড়ে তিন একর জমিতে তখন সাগরের মতো বিশাল একটি দীঘি খনন করা হয়, তাই তার স্ত্রী অনন্তবালা দেবী নামের সাথে যোগ করে এর নাম হয় অনন্ত সাগর।
এখানেই শেষ নয়, জমিদার আমলে নির্মিত ইংরেজি বর্ণমালা ‘ই’ আকৃতির আদলে ঐতিহ্যবাহী ও গৌরবমণ্ডিত বিদ্যাপীঠের অপূর্ব কারুকাজ ও নির্মাণশৈলী দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। বিদ্যালয়ের সামনে ও দীঘির পশ্চিমপাড়ে একটি ছোট মাঠ রয়েছে এবং বিদ্যালয়ের বাইরে রয়েছে ‘আর. কে. স্কুল খেলার মাঠ’ নামে একটি বিশাল মাঠ। বিদ্যালয়ে আধুনিক স্থাপনা বলতে রয়েছে – একটি দুইতলা, একটি তিনতলা, ছয়তলা ভবন নির্মানাধীন, একটি মসজিদ, একটি মিনি পার্ক, একটি ছাত্রাবাস এবং শিক্ষক কর্মচারীদের লজ বা থাকার নিজেস্ব জায়গা।
ঈশ্বরগঞ্জে বিশ্বেশ্বরী সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা:
গৌরীপুরের তৎকালীন জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় কাঁচামাটিয়া কোলে ১৯১৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা শহরে ঈশ্বরগঞ্জ বিশ্বেশ্বরী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে বিদ্যালয়টি মোমেনসিং ও জাফরশাহী পরগানার জায়গীরদার, গৌরীপুরের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদারদের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীকৃষ্ণ চৌধুরী বংশের পঞ্চম পুরুষ ও গৌরীপুর রাজবাড়ির তৃতীয় জমিদার আনন্দ কিশোর রায় চৌধুরী (ঈশ্বর চন্দ্র চৌধুরী) এর পুত্রবধু , চতুর্থ জমিদার রাজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর সহধর্মিণী ও পঞ্চম জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর মা বিশ্বেশ্বরী দেবীর নামানুসারে বিদ্যালয়ের নামকরণ করা হয় ‘বিশ্বেশ্বরী উচ্চ বিদ্যালয়’।প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক বাবু কালী কিশোর গুহ রায়-সহ সাত জন শিক্ষক, একজন অফিস সহকারী, একজন দপ্তরী ও একজন নৈশপ্রহরী নিয়ে বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয়।
মধ্যনগর বিশ্বেশ্বরী পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ প্রতিষ্ঠা:
ব্রিটিশ উপনিবেশ শাসনামলে তৎকালীন ময়মনসিংহের গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ও স্থানীয় শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিবর্গ সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যনগরে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তাই ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ১ জানুয়ারি ১৯২০ খ্রিঃ তাঁর মাতা বিশ্বেশ্বরী রায় চৌধুরীর নামানুসারে মধ্যনগর বিশ্বেশ্বরী মাইনর স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠাকালে তিনি প্রতিষ্ঠানের স্থান ও খেলার মাঠসহ ৫.৬০ একর জমিসহ নগদ অর্থ প্রদান করেন। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে নাম ছিল মধ্যনগর বিশ্বেশ্বরী এম ই (মাইনর এডুকেশন) স্কুল। সে সময়ে তৃতীয় শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত চালু ছিল।তবে গৌরীপুর উপজেলার নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানেন না যে, সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যনগর বাজারে তৎকালীন গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধূরীর এক গৌরবময় ইতিহাস ধারণ করে আছে আজকের মধ্যনগর বিশ্বেশ্বরী পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজটি।
ময়মনসিংহ শহরে দৃষ্টিনন্দন গৌরীপুর লজ প্রতিষ্ঠা:
ইতিহাস বলে রেলওয়ে স্থাপনের আগে নাসিরাবাদ শহরে পূর্ব ময়মনসিংহের প্রত্যেক জমিদারদের কমপক্ষে একটি করে বাংলো ছিল। তখন ব্রহ্মপুত্র নদ ছিল বিশাল। বর্ষাকালে বা অমাবস্যার রাতে নদী পার হওয়া ছিল কঠিন ও ঝুকিপূর্ণ। তাছাড়া দুইশ’ বছর আগে নাসিরাবাদ শহরের পাশ দিয়ে এই ব্রহ্মপুত্র নদ পার হতে কমপক্ষে ৫-৬ ঘন্টা সময় লাগতো। বাংলো শুধু রাজা জমিদারদের থাকার কক্ষ নয়। জমিদারি পরিচালনার জন্য বিভিন্ন রাজ কর্মচারি ও অতিথিরা সাময়িকভাবে সেখানে বসবাস করতেন। ময়মনসিংহ শহরের ব্রহ্মপুত্র নদের পাশে একটি কারুকাজ খচিত দ্বিতল বাংলো বাড়ি বা লজ অবস্থিত। বাংলো বাড়ির নামকরণ করা হয় ইংরেজি নামে ‘গৌরীপুর লজ’। এ লজের প্রায় একশত গজ দূরে বর্তমান পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ। ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী খুব সৌখিন ব্যক্তি ছিলেন। ১৮৯৭ সালের ১২ই জুন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ভূমিকম্পে ময়মনসিংহের শশীলজসহ বিভিন্ন জায়গার রাজবাড়ি ধংস হলে ময়মনসিংহ পৌরসভা কর্তৃক শহরে কোনো দোতালা পাকা ভবন নির্মাণের উপর সাময়িকভাবে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তখন তিনি চীন থেকে কারিগর এনে ময়মনসিংহ শহরে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে নির্মাণ করেন টিন, লোহা, কাঠের দৃষ্টিনন্দন একটি দোতালা বাংলো বাড়ি।
এটা ছিল ইংরেজদেরকে দেখানোর আরেকটি চ্যালেঞ্জ। ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘রাজা’ উপাধি দেওয়ার প্রস্তাব করলে তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ঐতিহাসিকদের ধারণা মহারাজ উপাধি পাওয়া জন্য তিনি ‘রাজা’ উপাধি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ইতিহাসে দেখা যায় ১৮৮৯ সালে রানি ভিক্টোরিয়া জমিদার ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীকে নবাব উপাধি প্রদান করেন, কিন্তু তার আগে দুইবার ব্রিটিশ সরকারের ‘বেগম’ উপাধি তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী তৎকালীন সময়ে শিক্ষা খাতে ৪৫ লাখ টাকা দান করেন। তখনকার সময়ে সারা পূর্ব বাংলায় শিক্ষাখাতে তিনিই সবচেয়ে বেশি অনুদান দিয়েছিলেন। সেক্ষেত্রে মহারাজ উপাধি পাওয়ার তার যোগ্যতা ছিল।
ময়মনসিংহের বাংলো বাড়িটি বর্তমানে সোনালী ব্যাংকের জোনাল অফিস হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে। তাছাড়া ময়মনসিংহের যাত্রা অভিনেতাদের আবেদনে তিনি নিজ খরচে সি কে ঘোষ রোড়ে নির্মাণ করেন অত্যাধুনিক অডিটোরিয়াম ‘অমরাবতী নাট্যমন্দির’ যা পরবর্তীতে ছায়াবাণী সিনেমা হলে পরিণত হয়।
গৌরীপুর হাউস প্রতিষ্ঠা:
তৎকালীন ময়মনসিংহের গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী ভারতের মনোমুগ্ধকর কালিম্পং শহরে গৌরীপুর হাউস নামে একটি বাংলো বাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে অবস্থিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর একটি শহর হল কালিম্পং। এটি তিস্তা নদীর ঠিক পূর্বে, দুর্গম পাহাড়ের মাঝে একটি উপত্যকায় অবস্থিত। অন্যতম আকর্ষণীয় শহরটি রঙ এবং সুবাসে সমৃদ্ধ। একসময় বাস করতেন রবীন্দ্রনাথ, সেই স্মৃতি আঁকড়ে গৌরীপুর হাউস এখন যেন ভূত বাংলো। অবহেলার ধুলো জমছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত কালিম্পঙের গৌরীপুর হাউসে। অথচ এই বাংলোই এক সময় গমগম করত প্রাণপ্রাচুর্যে। সেই গৌরবের ইতিহাসে এখন নকশা বুনছে মাকড়সার জাল।
কালিম্পং শহর থেকে দক্ষিণ দিকে রিংকিংপিং রোড ধরে দু-তিন কিলোমিটার পশ্চিম এগোলেই গৌরীপুর হাউস। এই বাড়ির সঙ্গেই জড়িয়ে বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস, যা এখন ঢাকা পড়ে গিয়েছে বিস্মৃতির ধুলোয়। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য ২০১৮ সালের ২১ মার্চ ভারতের রাজ্য হেরিটেজ কমিশন গৌরীপুর হাউস অধিগ্রহণ করেন।
ভারতের আনন্দ বাজার পত্রিকায় উল্লেখ্য যে, ‘কালিম্পং জেলা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে অবস্থিত জলপাইগুড়ি বিভাগের একটি জেলা। নিম্ন হিমালয়ে অবস্থিত। গৌরীপুর হাউসে এক অতিথি হয়ে আসতেন রবীন্দ্রনাথ, সেই স্মৃতি আঁকড়ে গৌরীপুর হাউস এখন যেন ভূতবাংলো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত কালিম্পঙের গৌরীপুর হাউস। ঝাঁ চকচকে কালিম্পং পলিটেকনিক কলেজের পাশে এই বাংলো যেন নিতান্তই বেমানান। অথচ এই বাড়ির সঙ্গেই জড়িয়ে বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।
ইতিহাস বলছে, এক সময় এই গৌরীপুর হাউসের মালিক ছিলেন বাংলাদেশের ময়মনসিংহ জেলার গৌরীপুর উপজেলার বাসিন্দা ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী। ১৯৩৮-১৯৪০ এই সময়ের মধ্যে গৌরীপুরের এই বাংলো বাড়িতে পা রেখেছিলেন বিশ্বকবিও। মোট চার বার ওই বাড়িতে উঠেছিলেন তিনি। শেষবার ১৯৪০ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, রবীন্দ্রনাথের ৮০তম জন্মদিনও এখানেই পালিত হয়। জন্মদিনের সকালে তিব্বতি সাধুরা ওই বাড়িতে তাঁর সঙ্গে সময় কাটান।
তথ্য বলছে, ওইদিন নিজের কবিতা কালিম্পঙের গৌরীপুর হাউস থেকেই টেলিফোনের মাধ্যমে আবৃত্তি করেছিলেন বিশ্বকবি। যা সরাসরি সম্প্রচারিত হয়েছিল আকাশবাণীতে। মুহূর্তে জুড়ে গিয়েছিল কলকাতা-কালিম্পং। সেই ইতিহাস ধরে রাখা আছে গৌরীপুর হাউসের গায়ে লাগানো একটি ফলকে। গড় উচ্চতা ১ হাজার ২৫০ মিটার (৪ হাজার ১০১ ফুট) কালিম্পং তিস্তা নদীর ধারে একটি শৈলশিরার উপর অবস্থিত। মনোরম জলবায়ু ও সহজগম্যতা একে জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র করেছে।
নেত্রকোণা শহরে তৎকালীন গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর কীর্তি:
সাধারণ মানুষের পানীয় জলের সুবিধার জন্য তৎকালীন গৌরীপুরের জমিদার ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী নেত্রকোনা শহরে খনন করে নামকরণ করা হয় তার মায়ের নামে ‘বিশ্বেশ্বরী ট্যাংক’, যা নিউটাউন বড় পুকুর নামে পরিচিত।নেত্রকোনার সাতপাইয়ে কালীবাড়ির জন্য মোমেনসিং পরগণার এজমালি সম্পত্তি থেকে দেবোত্তর সম্পত্তি তিনি দান করেন। নেত্রকোনা শহরে ছিল তাঁর বিশাল কাছারী বাড়ি। তা ছাড়াও অবিভক্ত বাংলায় ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর অনেক কীর্তি রয়েছে। প্রাচীন ইতিহাস আপডেট করতে হলে রেনেলের অংকিত মানচিত্রসহ ইতিহাস অনুসন্ধান করা প্রয়োজন, তা না হলে লুকিয়ে থাকা ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহ বা খোঁজা সম্ভব হবে না। কেননা প্রাচীন বইগুলোতে বর্তমান জেলা উপজেলার নাম উল্লেখ নেই।তথ্য সূত্রঃ (১) ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার – শ্রী শৌরীন্দ্রকিশোর রায় চৌধুরী (রামগোপালপুর এস্টেট এর জমিদার ও রাজা যোগেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরীর ৩য় পুত্র) (২) ময়মনসিংহের ইতিহাস ও ময়মনসিংহের বিবরণ – শ্রী কেদারনাথ মজুমদার (৩) ময়মনসিংহের জমিদারি ও ভূমিস্বত্ব – মো. হাফিজুর রহমান ভূঞা (৪) ব্রিটিশ ভূবিদ মেজর জেমস রেনেলের অংকিত কয়েকটি মানচিত্র (৫) সিরাজের পুত্র ও বংশধরদের সন্ধানে – ভারত উপমহাদেশের অন্যতম কৃতী ইতিহাসবিদ ও প্রফেসর ড. অমলেন্দু দে (৬) নেত্রকোণা জেলার ইতিহাস – আলী আহম্মদ খান আইয়োব (৭) উইকিপিডিয়ার উল্লেখিত শিরোনামগুলো থেকে (ক) গৌরীপুর উপজেলা – উইকিপিডিয়া (খ) ব্রজেন্দ্র কিশোর রায় চৌধুরী – উইকিপিডিয়া (গ) রামগোপালপুর জমিদার বাড়ি – উইকিপিডিয়া (ঘ) গৌরীপুর জমিদারবাড়ি – উইকিপিডিয়া। (৮) বাংলাপিডিয়া (৯) ম্যাগাজিন: পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স-২০২০, পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স-২০২১ ও ২০২২ (১০) ইতিহাস অনুসন্ধানী সংগঠন কর্তৃক প্রতিবেদন (এসিক এসোসিয়েশন, ক্রিয়েটিভ এসোসিয়েশন ও দি ইলেক্টোরাল কমিটি ফর পেন অ্যাওয়ার্ড অ্যাফেয়ার্স )।