তালাক দেওয়ার ভুল পদ্ধতি এবং কুফল
- আপডেট সময় : ০৯:৪২:৪৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ নভেম্বর ২০২২
- / ৭১
আলমগীর ইসলামাবাদী
ইসলামী শরীয়তে একান্ত প্রয়োজনে তালাক দেওয়ার অবকাশ রাখা হয়েছে এবং সেজন্য সুন্দর পদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে সে পদ্ধতি উপেক্ষা করতে দেখা যায়। আবার কোথাও পুরোপুরি উপেক্ষা করা না হলেও যথাযথ অনুসরণ করা হয় না। সমাজে তালাক দেওয়ার বিভিন্ন ভুল পদ্ধতি প্রচলিত রয়েছে এবং দিন দিন নতুন নতুন পদ্ধতির কথা শোনা যাচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট এবং শরীয়ত পরিপন্থী পদ্ধতি, যার কারণে একটি সুখী সংসার নিমিষেই শেষ হয়ে যায় এবং স্বামী-স্ত্রী উভয়ে অন্তর্জ্বালায় জ্বলতে থাকে। তা হল-একসাথে তিন তালাক দেওয়া। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে এভাবেই তালাক দেওয়া-নেওয়া হয়। অনেকে একেই তালাক দেওয়ার একমাত্র পদ্ধতি মনে করে। এটা ছাড়া ভিন্ন পন্থায় তালাক দিলে তালাক দেওয়া হয়েছে বলে মনে করে না।
এই ভুল রেওয়াজ এতই ব্যাপক যে, তালাক কার্যকরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও এভাবেই তালাক কার্যকর করে থাকে। তদ্রূপ শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-দরিদ্র সব শ্রেণীর লোকদের মধ্যেই এই প্রবণতা দেখা যায় যে, তারা যখন রাগে ক্ষোভে অথবা সিদ্ধান্ত নিয়ে লিখিত বা মৌখিকভাবে তালাক দেয় তখন একসাথে তিন তালাকই দিয়ে থাকে। এর কম তালাক দেওয়ার কোনো পন্থা আছে কি না সেটা জানারও প্রয়োজন বোধ করে না।
কখনও এমনও ঘটে যে, কেউ যদি এক তালাক বা দুই তালাক দেয় তাহলে তাকে তৃতীয় তালাক দিতে বাধ্য করা হয় এবং নানা রকম হুমকি-ধমকি দিয়ে, ঠাট্টা বিদ্রূপ করে কিংবা যেকোনো ভাবে উত্তেজিত করে তৃতীয় তালাক দেওয়ার পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়। দৃশ্যটা এমন থাকে যে, যতক্ষণ স্বামী তিন তালাক না দিচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত না সে নিজে ঠান্ডা হয়, না স্ত্রী, না অন্যান্য আত্মীয়-স্বজন। সন্তান-সন্ততির ভবিষ্যতের কথা, সংসার ভাঙ্গার কথা, দুই পরিবারের মাঝে শত্রুতা ও সংঘাতের কথা কোনোটাই মাথায় থাকে না। যেই তিন তালাক দেওয়া হল অমনি সবাই শান্ত সুবোধ হয়ে গেল। এখন ছোট ছোট সন্তানের কথা মনে পড়ে, নিঃষ্পাপ সন্তানদের চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠে এবং ঘর ভাঙ্গা সংসারের চিত্রটা এমন বিভৎস আকারে ধরা দিতে থাকে যে, প্রত্যেকে নিজের ভুল বুঝতে পারে।
স্বামী-স্ত্রী নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়। মাফ চাওয়া-চাওয়ির মাধ্যমে অতীত ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করে বৈবাহিক সম্পর্ক পুনর্বহাল করতে মরিয়া হয়ে যায়। কিন্তু ততক্ষণে বড় দেরি হয়ে গিয়েছে। নিজ হাতে সকল সুযোগ বিনষ্ট করা হয়েছে। তালাক দেওয়ার শরীয়ত সম্মত পদ্ধতি অনুসরণ না করার কারণে স্ত্রী তার জন্য সম্পূর্ণ হারাম হয়ে গিয়েছে। এখন স্ত্রীকে ইদ্দত চলা অবস্থায়ও পুনরায় গ্রহণ করারও সুযোগ নেই, নতুন করে বিবাহ করারও সুযোগ নেই। উপরন্তু শরীয়তের নিয়ম অমান্য করে মারাত্মক গুনাহ করা হয়েছে। আর অন্যায়ভাবে তালাক দেওয়া হলে স্ত্রীর উপরও চরম যুলুম করা হয়েছে, যা আরেকটি কবীরা গুনাহ ও হারাম।
যারা তিন তালাক দেওয়ার পর শরীয়তের বিধান জানতে মুফতী সাহেবদের কাছে আসেন তাদের অনেককে দেখা যায়, অত্যন্ত অসহায়ত্বের সাথে নিজের দুঃখের কথা বলে মুফতী সাহেবের মন গলাতে চেষ্টা করেন। নিষ্পাপ সন্তানদের কথা বলেন আর চোখ থেকে অশ্রু ঝরে। বিনয়ের সাথে অনুরোধ করতে থাকেন যেভাবেই হোক কোনো হিলা-বাহানা বের করে তার পরিবারটাকে যেন ধ্বংস হওয়া থেকে বাঁচানো হয়।
এমনকি তিন তালাকের হুকুম নস্যাৎ করার জন্য বিশেষ কোনো কাফফারা থাকলে তা যেন বাতলে দেওয়া হয়। মোটকথা, যেকোনো উপায়ে দাম্পত্য সম্পর্ক ফিরে পাওয়ার জন্য অনুনয় বিনয় করতে থাকে। কিন্তু তাদের এ সকল আবদার-অনুরোধ বিফল। এতে শরীয়তের বিধানে পরিবর্তন হয় না। স্ত্রী তার জন্য সম্পূর্ণ হারাম হয়ে গেছে। আর এটা হয়েছে শরীয়তের নিয়ম লঙ্ঘন করে একসাথে তিন তালাক দেওয়ার কারণে। এখন পুনরায় তাকে স্ত্রী রূপে ফিরে পাওয়ার যে সম্ভাবনাটি রয়েছে তা অত্যন্ত দূরবর্তী সম্ভাবনা। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় বৈধ পন্থার পরিবর্তে নানা রকম হিলা-বাহানার আশ্রয় নেওয়া হয়, যা যেমন অশালীন তেমনি শরীয়তের দৃষ্টিতে অবৈধ ও লানতযোগ্য কাজ।
রুজু করার মনগড়া পদ্ধতিসমূহ :
অনেক জায়গায় তালাকের শরয়ী বিধান উপেক্ষা করা হয়। স্পষ্ট তিন তালাক দেওয়া সত্ত্বেও তালাকপ্রাপ্তা মহিলার সাথে অনায়াসে ঘর-সংসার করতে থাকে। এমনও শোনা যায়, তালাক দেওয়ার পর স্ত্রী বাপের বাড়ি চলে গেছে। পরে তালাকদাতা চাপে পড়ে কিংবা মনের টানে মহিলাটিকে নিজ বাড়িতে ফিরিয়ে এনেছে এবং স্বামী-স্ত্রীর মতো জীবন-যাপন করছে। অথচ এভাবে তালাকপ্রাপ্তাকে ফিরিয়ে আনা এবং একসাথে জীবন-যাপন করা সম্পূর্ণ হারাম।
সমাজে এমনও ঘটে যে, এভাবে হারাম জীবন-যাপনের পক্ষে অনেক প্রগতিবাদী ‘মুরববী’র সমর্থন থাকে। সান্ত্বনার সুরে একেকজন একেক ধরনের উপদেশ দেন আর বলতে থাকেন, আরে রাগের মাথায় তালাক দিলে স্ত্রী তালাক হয় না। অন্তরে তালাকের নিয়ত না থাকলে তালাক হয় না। স্ত্রী তালাক দেওয়ার সময় নিজ কানে না শুনলে তালাক হয় না। স্ত্রী যদি তালাকের রেজিস্ট্রি গ্রহণ না করে ফিরিয়ে দেয় তাহলে তালাক হয় না। যতক্ষণ স্ত্রী তালাকনামা না পড়বে এবং কবুল না করবে ততক্ষণ তালাক কার্যকর হয় না। শুধু লিখে তালাক দিলে তালাক হয় না, মুখে উচ্চারণ করতে হয়। স্ত্রী গর্ভবতী থাকা অবস্থায় তালাক দিলে তালাক হয় না ইত্যাদি। এভাবে একের পর এর তালাকের ‘সমাধান’ বাতলাতে থাকে। এগুলো সব জাহেল ও মুর্খদের অজ্ঞতাপ্রসূত ও মনগড়া যুক্তি, যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। নিঃসন্দেহে এ সকল ক্ষেত্রেও শুরু থেকেই তিন তালাক কার্যকর হয়ে যাবে। সুতরাং তিন তালাক দেওয়ার পর এভাবে স্ত্রীকে পুনঃগ্রহণ করার অর্থ হল, প্রকাশ্য ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়া। তারা যতদিন একসাথে জীবন কাটাবে ততদিন হারাম কাজের মধ্যেই জীবন অতিবাহিত হবে। এতে শুধু তালাকদাতা এবং তালাকপ্রাপ্তা গুনাহগার হবে না; বরং তাদেরকে এই হারাম জীবন-যাপনের সুযোগ যারা করে দিয়েছে তারাও গুনাহগার হবে।
কেউ কেউ তিন তালাক দেওয়ার পর তা গোপন রাখে। ঘটনাক্রমে দু’একজন জেনে ফেললেও সাক্ষী প্রমাণ না থাকার কারণে সাফ অস্বীকার করে বসে। কখনও কখনও তিন তালাক দেওয়া সত্ত্বেও এক তালাক বা দুই তালাক দেওয়ার কথা প্রচার করে। এভাবে মিথ্যা বলে তিন তালাকের হুকুম-স্ত্রী সম্পূর্ণরূপে স্বামীর জন্য হারাম হয়ে যাওয়া- থেকে বাঁচতে চায়। অতঃপর যখন মুফতী সাহেবের কাছে ফতোয়া নেওয়ার জন্য আসে তখন তিন তালাককে দুই তালাক বানিয়ে কাগজে লিখে দেয়। মুফতী সাহেব যেহেতু গায়েব জানে না তাকে লিখিত বিষয়ের উপর নির্ভর করে, প্রয়োজনে মৌখিক বক্তব্যের মাধ্যমে যাচাই করে উত্তর প্রদান করতে হয়। যদি প্রশ্নপত্রে দুই তালাকের কথা উল্লেখ থাকে তাহলে তিনি দুই তালাকের শরয়ী হুকুম অনুযায়ী ফতোয়া প্রদান করবেন। ফলে উত্তরপত্রে দেখা যাবে দুই তালাকের বিধানানুযায়ী মহিলাটি তালাকদাতার জন্য এখনও সম্পূর্ণ হারাম হয়নি। (যদিও কার্যত আল্লাহর বিধানে মহিলাটি তালাকাদাতার জন্য সম্পূর্ণ হারাম হয়েছে। কেননা, তাকে তিন তালাক প্রদান করা হয়েছে) এই ফতোয়া প্রদানের ক্ষেত্রে মুফতী সাহেব কোনো ভুল করেননি। তিনি তার দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছেন। কিন্তু প্রশ্নকর্তা এখানে খেয়ানত করেছে। সত্যের বিপরীতে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে। তিন তালাককে দুই তালাক বানিয়েছে এবং তিন তালাকের পরিবর্তে দুই তালাকের হুকুম নিয়ে নিয়েছে।
যদিও সে মুফতী সাহেবকে ধোকা দিয়েছে এবং হয়তো এই ফতোয়া নিয়ে এলাকাবাসীকেও ধোকা দিবে, কিন্তু আল্লাহকে তো ধোকা দিতে পারবে না। তার সকল কাজ আল্লাহ জানেন। এলাকাবাসীর প্রতিবাদের ভয়ে হয়তো এই ফতোয়াকে সনদ বানিয়ে প্রচার করবে যে, অমুক মুফতী সাহেব কিংবা অমুক বড় মাদরাসা থেকে এই ফতোয়া দেওয়া হয়েছে। সত্য গোপন করা হবে। সমাজ তাদেরকে স্বামী-স্ত্রী মনে করবে, কিন্তু শরীয়তের বিচারে মহিলাটি তালাকদাতার জন্য হালাল হয়ে যাবে না; বরং বিধান অনুযায়ী হারামই থাকবে এবং তাদের মেলামেশা ব্যভিচার বলে গণ্য হবে। এই জঘন্য অপরাধের কারণে পরকালে কঠিন শাস্তি তাদেরকে ভোগ করতে হবে।
কেউ কেউ তিন তালাকের কঠিন হুকুম থেকে বাঁচার জন্য শরীয়তের বিধানের মধ্যে ফাঁক-ফোকর তালাশ করে থাকে। যখন ফিকহে হানাফীতে কোনো ছাড়-মহিলাটিকে পুনরায় গ্রহণ করার সুযোগ-খুঁজে পায় না তখন হানাফী মাযহাব ছেড়ে গায়রে মুকাল্লিদদের কাছে ধর্ণা দেয়। কারণ তাদের প্রোপাগান্ডা হল, একসাথে একই মজলিসে তিন তালাক দিলেও এক তালাক হয় এবং স্বামী পুনরায় তালাকপ্রাপ্তাকে গ্রহণ করতে পারে।
যারা এই ব্যতিক্রমী মত অনুসরণ করবে তারা নিঃসন্দেহে অবৈধ জীবন যাপন করতে থাকবে। কারণ এই মত কুরআন, সুন্নাহ, ইজমা ও কিয়াস, শরীয়তের এই চার দলীলের সম্পূর্ণ বিরোধী। এছাড়া সাহাবা, তাবেয়ীন, প্রসিদ্ধ চার ইমাম এবং জুমহুরে উম্মতের অনুসৃত মত ও আমলের পূর্ণ খেলাফ। অতএব গুটি কতক মানুষের ভ্রান্ত মত অনুসরণ করে সারা জীবন হারাম কাজে অতিবাহিত করা নিজের জন্য জাহান্নামের গর্ত খোঁড়া ছাড়া আর কিছু নয়।
আমাদের ভুল এই যে, বিবাহের আগে তালাকের মাসআলা ভালোভাবে জানি না এবং জানারও প্রয়োজন বোধ করি না। এমনকি বিবাহের পরও তালাকের মাসআলা জানার চেষ্টা করি না। ফলে এই ভুলের খেসারত পরে দিতে হয়। যদি মাসআলা জানার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হত তাহলে নির্দ্বিধায় তিন তালাক দেওয়ার সাহস হত না এবং সুখের সংসার ভেঙ্গে যেত না। দুই পরিবারের মাঝে শত্রুতা সৃষ্টি হত না এবং অনাকাংখিত পরিস্থিতির শিকার হতে হত না। সুতরাং হুট করে তিন তালাক দিতে উদ্যত হবে না। রাগের অবস্থায় ভুলেও তালাকের নাম নিবে না। প্রচন্ড রাগ হলে নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করবে। সম্ভব হলে দ্রুত স্থান ত্যাগ করবে। তালাক দিলেই যে জীবনে শান্তি ফিরে আসবে এমন তো নয়। তাই ধৈর্য্য ধারণ করাই শ্রেয় এবং শরীয়তের পদ্ধতিতে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা কর্তব্য।
তালাকদাতার জন্য মহিলাটি কখন হালাল হবে?
তালাকপ্রাপ্তা মহিলা যদি ইদ্দত শেষে অন্যত্র বিবাহ হয় এবং সে স্বামীর সাথে তার নিশ্চিত মেলামেশা হয় অতঃপর সেই স্বামী কোনো কারণে স্বেচ্ছায় মহিলাটিকে তালাক দেয় কিংবা স্বামীর মৃত্যু হয় তাহলে মহিলাটি ইদ্দত পালন করার পর পূর্ণ স্বাধীন থাকবে-ইচ্ছা করলে অন্যত্র বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। আবার ইচ্ছা করলে প্রথম স্বামীর সাথে বিবাহ বসতে পারবে। তাকে প্রথম স্বামীর সাথে বিবাহে বাধ্য করা যাবে না; তারা নিজেরা যদি পুনরায় দাম্পত্য সম্পর্কে আগ্রহী হয় তাহলে নতুন মহর ধার্য করে স্বাক্ষীদের উপস্থিতিতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে।
এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন যে, দ্বিতীয় স্বামীকে জোর করে তালাক দিতে বাধ্য করা সম্পূর্ণ নিষেধ এবং বিবাহের আগে এই শর্ত জুড়ে দেওয়া যে, বিবাহের পর দ্বিতীয় স্বামী অবশ্যই স্ত্রীকে তালাক দিতে বাধ্য থাকবে, সম্পূর্ণ নাজায়েয। কেউ যদি এ রকম করে তাহলে সেটা আল্লাহর লানত ও আযাবের কারণ হবে। হাদীস শরীফে এসেছে, যে ব্যক্তি এভাবে (শর্তের সাথে) হালাল করার দায়িত্ব নিবে এবং যার জন্য করবে উভয়ের উপর আল্লাহর লানত।
বলাবাহুল্য যে, আত্মমর্যাদাসম্পন্ন কোনো মানুষ কখনই তালাকপ্রাপ্তা মহিলাকে ঘরে উঠানোর জন্য হিলা বাহানার পথ বেছে নিতে পারে না। এটা সুস্থ আকলেরও পরিপন্থী। সুতরাং তালাকের ক্ষেত্রে কুরআন-হাদীসের নির্দেশনা যথাযথ অনুসরণ করা কর্তব্য এবং সুস্থ সুন্দর জীবন যাপনের ব্যবস্থা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।
একসাথে তিন তালাক-
যদি কেউ পূর্বাপর না ভেবে ঠান্ডা মাথায় হোক কি রাগের ঝোঁকে হোক একসাথে তিন তালাক দিয়ে ফেলে তাহলে সে একটি মারাত্মক অপরাধ করল এবং এক নিমিষেই একটি সুখের সংসার তছনছ করে দিল। সে নিজেই কৃতকর্মের কুফল টের পাবে। এভাবে তালাক দেওয়া মারাত্মক গুনাহ এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু কেউ দিয়ে ফেললে এই যুক্তি চলবে না যে, সে অন্যায়ভাবে তালাক দিয়েছে অতএব তা কার্যকর হবে না। কিংবা শুধু এক তালাক হবে। যারা এরূপ ধারণা করেন তারা শরীয়তের বিধান না জানার কারণে করে থাকেন। শরীয়তের বিধান হল, তালাক সংকল্প করে দিক অথবা ঠাট্টাচ্ছলে, খেল-তামাশা করে দিক সর্বাবস্থায় তালাক কার্যকর হয়ে যাবে। আর স্পষ্ট শব্দে তালাক দেওয়ার সাথে অন্তরের নিয়ত থাকা শর্ত নয়। সুতরাং যেভাবেই হোক একসাথে তিন তালাক দেওয়ার সাথে সাথেই স্ত্রীর উপর তিন তালাক কার্যকর হয়ে যাবে।
একাধিক সহীহ হাদীসে আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একসাথে তিন তালাক দেওয়াকে তিন তালাকই গণ্য করেছেন। যদিও এভাবে তালাক দেওয়ার কারণে অত্যন্ত রাগান্বিত হয়েছেন।
প্রথম হাদীস-
عن محمود بن لبيد قال : أخبر رسول الله صلى الله عليه وسلم عن رجل طلق امرأته ثلاث تطليقات جميعا فقام غضبان، فقال : أيلعب بكتاب الله وأنا بين أظهركم؟ فقام رجل فقال : يا رسول الله صلى الله عليه وسلم ألا أقتله.
মাহমুদ ইবনে লাবীদ বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জানানো হল যে, জনৈক ব্যক্তি তার স্ত্রীকে তিন তালাক দিয়েছে। তিনি (একথা শুনে) রাগান্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, তোমাদের মাঝে আমি থাকা অবস্থায় আল্লাহর কিতাবের সাথে উপহাস করা হচ্ছে? এ সময় এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি তাকে কতল করব না?-সুনানে নাসায়ী ২/৯৮
এই হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একসাথে তিন তালাক দেওয়ার উপর নেহায়েত অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন এবং কেউ কেউ তার ওই কাজকে হত্যাযোগ্য অপরাধ মনে করেছেন। আর এ কথা কোথাও নেই যে, তিনি এই তিন তালাককে তালাক হিসেবে গণ্য করেননি অথবা এটাও এক তালাকে রজয়ী করে মহিলাটিকে তালাকদাতার কাছে ফিরিয়ে দিয়েছেন।
কাজী আবু বকর ইবনুল আরাবী এই হাদীসে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন তালাকের হুকুম কার্যকর করেছেন।
দ্বিতীয় হাদীস-
সাহাবী উয়াইমির আজলানী রাহ. সম্পর্কে বর্ণিত হয়েছে যে, তিনি এবং তার স্ত্রী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে লিআন করলেন। যখন লিআন শেষ হল, তখন উয়াইমির রা. বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! এখন যদি আমি তাকে আমার কাছে রাখি তাহলে আমি মিথ্যাবাদী। অতঃপর উয়াইমির রা. হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সামনে স্ত্রীকে তিন তালাক দিলেন। হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা কার্যকর করলেন এবং তাদের মাঝে বিচ্ছেদ ঘটালেন। – ‘সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৩০৯; সুনানে দাউদ, হাদীস ২২৫০’
এই হাদীস থেকে সুস্পষ্ট প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তিন তালাককে তিন তালাকই গণ্য করেছেন এবং তার হুকুমও কার্যকর করেছেন। আর পূর্বে উল্লেখিত মাহমুদ ইবনে লাবীদের হাদীসটিও তা প্রমাণ করে। পক্ষান্তরে কোথাও একথা পাওয়া যায় না যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একসাথে দেওয়া তিন তালাককে তালাক সাব্যস্ত করেননি বা এক তালাকে রজয়ী গণ্য করেছেন।
তৃতীয় হাদীস-
হযরত আলী রা.-এর শাহাদাতের পর যখন হযরত হাসান রা. খলীফা নির্বাচিত হলেন তখন তার স্ত্রী আয়েশা খাছআমিয়া তাকে মোবারকবাদ জানান। হযরত হাসান রা. স্ত্রীকে বললেন, তোমার এই মোবারকবাদ কি হযরত আলী রা.-এর শাহাদাতের কারণে? তুমি এতে খুশি প্রকাশ করছ? তোমাকে তিন তালাক দিলাম।
যখন তার ইদ্দত শেষ হয়ে গেল তখন হাসান রা. তার অবশিষ্ট মহর এবং অতিরিক্ত দশ হাজার দিরহাম পাঠিয়ে দিলেন। আয়েশা খাছআমিয়ার হাতে যখন এগুলো পৌঁছল তিনি বলতে লাগলেন, প্রিয়ের বিচ্ছেদের তুলনায় এ সম্পদ অতি তুচ্ছ। হযরত হাসান রা. যখন এ কথা শুনলেন তখন অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন-
لو لا أني سمعت جدي أو حدثني أبي أنه سمع جدي يقول : أيما رجل طلق امرأته ثلاث عند الأقراء أو ثلاثا مبهمة لا تحل له حتى تنكح زوجا غيره لراجعتها.
আমি যদি নানাজানকে বলতে না শুনতাম কিংবা বলেছেন, আমার আববার মাধ্যমে নানাজানের এ কথা না শুনতাম, ‘যে ব্যক্তি স্ত্রীকে হায়েয থেকে পবিত্র অবস্থায় পর্যায়ক্রমে তিন তালাক দিল কিংবা একসাথে তিন তালাক দিল তার জন্য ওই স্ত্রী হালাল হবে না অন্য পুরুষের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া ছাড়া, তাহলে আমি তাকে ফিরিয়ে আনতাম। -আসসুনানুল কুবরা ৭/৩৩৬
চতূর্থ হাদীস-
عن عبادة بن الصامت قال : طلق جدي امرأته له ألف تطليقة، فانطلقت إلى النبي صلى الله عليه وسلم فسألته، فقال : أما اتقى الله جدك، أما ثلاثة فله، وأما تسع مأة وسبعة وتسعون فعدوان وظلم، إن شاء الله عذبه وإن شاء غفر له.
উবাদা ইবনে ছামেত রা. বলেন, আমার দাদা তার স্ত্রীকে ‘এক হাজার তালাক’ দিলেন। আমি তখন হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কাছে গিয়ে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, তোমার দাদা কি আল্লাহকে ভয় করেনি? তিনটি তো তার অধিকার (যা কার্যকর হয়ে গেছে) আর বাকি নয়শত সাতানববইটি হল সীমালঙ্ঘন ও জুলুম। আল্লাহ ইচ্ছা করলে তাকে ক্ষমা করে দিতে পারেন অথবা শাস্তিও দিতে পারেন।
এসকল হাদীস দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, একসাথে তিন তালাক প্রদান করলে তিন তালাকই হয়। নানা রকম হিলা-বহানা করে তিন তালাককে বাতিল তালাক অথবা এক তালাকে রজয়ী সাব্যস্ত করার অপচেষ্টা মুর্খতা ছাড়া আর কিছুই নয়। এর কারণে মহিলা কখনও হালাল হয়ে যাবে না।
সারকথা হল, বিবাহ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এর জন্য সময় নিয়ে প্রস্ত্ততি গ্রহণ করতে হয়। অনেক বুঝে, চিন্তা-ফিকির করে শরীয়তসম্মত পন্থায় বিবাহ সম্পন্ন করতে হয়। তাই আগ-পিছ না ভেবে হুট করে তালাক প্রদান করা কখনই উচিত নয়। যখন তালাক দেওয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না তখন শরীয়তের নির্দেশিত পন্থায় তালাক দিবে। চিন্তা-ভাবনা ছাড়া শুধু রাগের বশবর্তী হয়ে নির্দ্বিধায় তালাক দিয়ে ফেলা শুধু অবৈধ ও গুনাহই নয়; বরং সামাজিক জীবনেও এর মারাত্মক ক্ষতি রয়েছে। এর ফলে দুঃখ-দুর্দশা, হতাশা ও দুশ্চিন্তা ভর করে।
একমাত্র শান্তি ও কামিয়াবি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে শিক্ষা ও নির্দেশনা উম্মতের মাঝে রেখে গেছেন তার মধ্যে। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ঐ নির্দেশনার উপর অবিচল থাকা আবশ্যক। সমস্ত ভুল পথ ও পদ্ধতি পরিহার করে চলতে হবে। পূর্বের গুনাহের জন্য আল্লাহর কাছে কায়মনো বাক্যে ইস্তেগফার করতে হবে। আগামী জীবন নবীর আদর্শ অনুসরণ করে পরিচালনা করতে দৃঢ় সংকল্প করতে হবে। আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে কবুল করুন। আমীন।