দাম্পত্য জীবন সুখময় রাখার শরীয় নির্দেশনা
- আপডেট সময় : ০৯:১০:৫৩ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৩ নভেম্বর ২০২২
- / ৭৫
আলমগীর ইসলামাবাদী
আল্লাহ তা-আলার অশেষ শুকরিয়া, তিনি মুসলমানকে ইসলামের মতো পূর্ণাঙ্গ দ্বীন দান করেছেন। নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত আদায় করার পথ ও পন্থা আল্লাহপাক পবিত্র কোরআনে বলে দিয়েছেন। তেমনি লেনদেন, আচার-আচরণ, পারিবারিক ও সামাজিক জীবন কেমন হবে তাও জানিয়ে দিয়েছেন।
বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে দাম্পত্যজীবন ও পারিবারিক জীবনের সূচনা হয়। ইসলামী শরীয়তে এই সম্পর্ক কায়েম করতে হলে যেমন সুনির্ধারিত কিছু বিধান রয়েছে, তেমনি প্রয়োজনে এই সম্পর্ক ছিন্ন করতে হলেও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। কুরআন-হাদীসে সেগুলো অনুসরণ করারও জোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। যদি সেই বিধানগুলো মান্য না করা হয়, তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে অমান্য করা হবে যা একটি মারাত্মক গুনাহ। সাথে সাথে এই অমান্য করার কারণে জীবনের পদে পদে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে এবং অসংখ্য বালা-মুসীবতে নিপতিত হতে হবে, যার বাস্তব নমুনা আমাদের সমাজ জীবনে প্রতিদিন সৃষ্টি হচ্ছে। যা পেপার-পত্রিকায় শিরোনাম হচ্ছে। বিশেষত শরীয়ত পরিপন্থী পদ্ধতিতে তালাক প্রদান করে দাম্পত্য জীবনের অবসান ঘটালে যে পেরেশানি ও জটিলতা সৃষ্টি হয়, তা বর্ণনাতীত।
বিবাহ করার উদ্দেশ্য তালাক দেওয়া নয় :
বিবাহের মাধ্যমে যে দাম্পত্য সম্পর্কের সূচনা হয় তা অটুট থাকা এবং আজীবন স্থায়ীত্ব লাভ করা ইসলামে কাম্য। সুতরাং স্বামী কখনও বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন করার চেষ্টা করবে না এবং বিবাহ-বিচ্ছেদের পরিস্থিতিও সৃষ্টি করবে না। কেননা বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন হলে এর কুপ্রভাব শুধু স্বামী-স্ত্রীর উপর সীমাবদ্ধ থাকে না; বরং গোটা পরিবারটিই তছনছ হয়ে যায় এবং সন্তান-সন্ততির জীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। কোনো কোনো সময় এই ঘটনার জের পরিবারের গন্ডি অতিক্রম করে বংশীয় কোন্দলে পরিণত হয় এবং সামাজিক জীবনে এর অত্যন্ত খারাপ প্রভাব পড়ে।
এজন্য যে সকল কারণে দাম্পত্য সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার উপক্রম হয়, সেগুলো দূর করার জন্য ইসলামী শরীয়ত বিভিন্ন বিধান দিয়েছে এবং এ বিষয়ে কুরআন-হাদীসে অনেক নির্দেশনা রয়েছে। প্রথমে বুঝিয়ে-শুনিয়ে সমাধান করতে বলা হয়েছে। এরপর স্ত্রীর সাথে শয্যা ত্যাগ, সতর্ক করা, শাসন করার পথ অবলম্বন করার আদেশ করা হয়েছে। এতটুকুতে মীমাংসা না হলে উভয় পক্ষে দুজন শালিস নিযুক্ত করে একটি চুড়ান্ত ফয়সালায় উপনীত হওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। এগুলো হল দাম্পত্য জীবনে ইসলামী হেদায়েতের অনন্য বৈশিষ্ট্য। আফসোস! আমাদের যদি বোধোদয় হত এবং ইসলামী নির্দেশনাকে আদর্শ বানাতে পারতাম! সুতরাং আবেগের বশিভূত হয়ে নয়; বরং বুঝে-শুনে, চিন্তা-ফিকির করে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।
স্বামী-স্ত্রীর প্রতি কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা :
সাধারণত বৈবাহিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হওয়ার পিছনে মৌলিক যে কারণগুলো থাকে সেগুলো হল, স্বামী-স্ত্রী একে অপরের হক যথাযথ আদায় না করা। একজন অন্যজনকে গুরুত্ব না দেওয়া। কথায়-কাজে অযথা দ্বিমত পোষণ করা। একে অন্যের প্রতি আস্থা না রাখা, বিশ্বাস না করা। এ সকল কারণে একসময় তাদের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ চরমে পৌঁছে এবং দাম্পত্য জীবন ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম হয়। সুতরাং উভয়ের কর্তব্য হল, পরস্পরের হকগুলো যথাযথভাবে জানা এবং তা আদায় করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করা। কোনো ক্ষেত্রে দোষ-ত্রুটি হয়ে গেলে তা অকপটে স্বীকার করে নেওয়া এবং অতি দ্রুত সেটাকে শুধরে নেওয়া। এভাবে সবকিছুকে সহজভাবে মেনে নেওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা। তাহলে সম্পর্ক দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হবে। এরকম শুধরে নেওয়া ও মেনে নেওয়ার অভ্যাস গড়ে না তুললে সামান্য মনোমালিন্যেও অন্তরে প্রচন্ড কষ্ট অনুভব করবে। এখানে স্বামী-স্ত্রীর কিছু শরীয় হক তুলে ধরা হল।
* স্বামীর ওপর স্ত্রীর হকসমূহ :
১. স্ত্রীর সাথে সর্বদা ভালো আচরণ করা।
২. স্ত্রীর কোনো কথায় বা কাজে কষ্ট পেলে ধৈর্য্য ধারণ করা।
৩. উচ্ছৃঙ্খল, বেপর্দা চলাফেরা করতে থাকলে নম্র ভাষায় তাকে বোঝানো।
৪. সামান্য বিষয় নিয়ে স্ত্রীর সাথে ঝগড়া-বিবাদ না করা, কথায় কথায় ধমক না দেওয়া, রাগ না করা।
৫. স্ত্রীর আত্মমর্যাদায় আঘাত করে এমন বিষয়ে সংযত থাকা। শুধু শুধু স্ত্রীর প্রতি কু-ধারণা না করা। স্ত্রীর সম্পর্কে উদাসীন না থাকা।
৬. সামর্থ্যানুযায়ী স্ত্রীর খোরপোষ দেওয়া। অপচয় না করা।
৭. নামায পড়া এবং দ্বীনের আহকাম মেনে চলার জন্য উৎসাহ দিতে থাকা। হায়েয-নেফাসের মাসআলাগুলো ভালোভাবে শিক্ষা দেওয়া। শরীয়ত পরিপন্থী কাজ থেকে বিরত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করা।
৮. একাধিক স্ত্রী থাকলে তাদের মাঝে সমতা রক্ষা করা।
৯. চাহিদানুযায়ী তাদের সাথে মেলামেশা করা।
১০. অনুমতি ব্যতীত আযল অর্থাৎ মেলামেশার সময় শেষ মুহূর্তে স্বাভাবিক স্থান ত্যাগ না করা।
১১. একান্ত নিরুপায় না হলে তালাক না দেওয়া এবং প্রয়োজনের ক্ষেত্রে শরীয়ত-গৃহীত পন্থায় তালাক দেওয়া।
১২. প্রয়োজন মাফিক থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা।
১৩. মাঝে মাঝে স্ত্রীর নিকটাত্মীয়দের সাথে দেখা-সাক্ষাত করার সুযোগ করে দেওয়া।
১৪. স্ত্রীর সাথে মেলামেশার চিত্র অন্যের কাছে বর্ণনা না করা।
১৫. প্রয়োজনে স্ত্রীকে শাসন করা, সতর্ক করা। শরীয়ত যতটুকু অনুমতি দিয়েছে তার চেয়ে বেশি হাত না তোলা।
* স্ত্রীর ওপর স্বামীর হকসমূহ :
১. সর্বদা স্বামীর মন জয় করার চেষ্টা করা।
২. স্বামীর সাথে অসংযত আচরণ না করা। স্বামীকে কষ্ট না দেওয়া।
৩. শরীয়তসম্মত প্রত্যেক কাজে স্বামীর আনুগত্য করা। গুনাহ এবং শরীয়ত বিরোধী কাজে অপারগতা তুলে ধরা এবং স্বামীকে নরম ভাষায় বোঝানো।
৪. প্রয়োজনাতিরিক্ত ভরণ-পোষণ দাবি না করা।
৫. পরপুরুষের সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক না রাখা।
৬. স্বামীর অনুমতি ছাড়া কাউকে ঘরে ঢোকার অনুমিত না দেওয়া।
৭. অনুমতি ছাড়া ঘর থেকে বের না হওয়া।
৮. স্বামীর সম্পদ হেফাযত করা। অনুমতি ছাড়া সেখান থেকে কাউকে কোনো কিছু না দেওয়া।
৯. স্বামীকে অসন্তুষ্ট করে অতিরিক্ত নফল নামাযে মশগুল না থাকা। অতিরিক্ত নফল রোযা না রাখা।
১০. স্বামী মেলামেশার জন্য আহ্বান করলে শরীয়তসম্মত কোনো ওযর না থাকলে আপত্তি না করা।
১১. স্বামীর আমানত হিসেবে নিজের ইজ্জত-আব্রু হেফাযত করা। কোনো ধরনের খেয়ানত না করা।
১২. স্বামী দরিদ্র কিংবা অসুন্দর হওয়ার কারণে তাকে তুচ্ছ না করা।
১৩. স্বামীকে কোনো গুনাহের কাজ করতে দেখলে আদবের সাথে তাকে বিরত রাখা।
১৪. স্বামীর নাম ধরে না ডাকা।
১৫. কারো কাছে স্বামীর বদনাম, দোষ-ত্রুটি বর্ণনা না করা।
১৬. শ্বশুর-শাশুড়িকে সম্মানের পাত্র মনে করা। তাদেরকে ভক্তি-শ্রদ্ধা করা। ঝগড়া-বিবাদ কিংবা অন্য কোনো উপায়ে তাদের মনে কষ্ট না দেওয়া।
১৭. সন্তানদের লালন-পালনে অবহেলা না করা।
উত্তম স্ত্রীর গুণাবলি :
কুরআন-হাদীসের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, উত্তম স্ত্রী হল যে স্বামীকে সম্মান করে। স্বামীর বশ্যতা স্বীকার করে। স্বামীর আদেশ-নিষেধ মান্য করে। স্বামীর ধন-সম্পদ হেফাযত করে এবং অন্যান্য হকসমূহ যথাযথভাবে আদায় করে। সাথে সাথে নিজের সতীত্ব রক্ষা করে, শরীয়তের বিধানুসারে জীবন পরিচালনা করে।
স্বামীর উপস্থিতি-অনুপস্থিতি সর্বাবস্থায় নিজের সতীত্ব এবং স্বামীর ধন-সম্পদ হেফাযত করা স্ত্রীর কর্তব্য। সাধারণত এ দু’টি ক্ষেত্রে মহিলাদের থেকে সবচেয়ে বেশি খেয়ানত হয়ে থাকে। কোনো কোনো মহিলার ক্ষেত্রে এমনও ঘটে যে, স্বামী ঘর থেকে বের হলে চাকরি বা অন্য কোনো স্থানে গেলে সেই সুযোগে স্বামীর অজান্তে নিজেকে নাফরমানির কাজে জড়িয়ে ফেলে। স্বামীর উপস্থিতিতে এটা সে করতে পারত না। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এতে স্বামীকে ধোকা দেওয়া হলেও প্রকারান্তরে এটা হচ্ছে নিজের জীবনে অভিশাপ টেনে আনা। সুতরাং স্ত্রীর অবশ্যকর্তব্য হল, আল্লাহকে হাযির-নাযির জেনে স্বামীর উপস্থিতি-অনুপস্থিতি সর্বাবস্থায় নিজের ইজ্জত-আব্রু সংরক্ষণ করা। হাদীস শরীফে আছে-‘উত্তম স্ত্রী হল, যখন তুমি তার দিকে তাকাও তখন সে তোমাকে আনন্দিত করে। যখন তাকে আদেশ কর তখন সে আনুগত্য করে আর যখন তুমি স্থানান্তরে যাও তখন সে তার ইজ্জত-আব্রু রক্ষা করে এবং সম্পদ হেফাযত করে।’
আর যে স্ত্রী শরীয়তের হুকুম মেনে চলে, স্বামীর আদেশ মান্য করে, তার খেদমত করে, নিজের সতীত্ব রক্ষা করে হাদীস শরীফে তার জন্য জান্নাতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে।
হযরত আবদুর রহমান ইবনে আউফ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘যে নারী পাঁচ ওয়াক্ত নামায আদায় করে, রমযান মাসের রোযা রাখে, লজ্জাস্থানের হেফাযত করে এবং স্বামীর অনুগত থাকে, তাকে বলা হবে তুমি; যে দরজা দিয়ে চাও জান্নাতে প্রবেশ কর।’ – ‘মুসনাদে আহমদ, হাদীস ১৬৬১’
পক্ষান্তরে যে স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে ভালো আচরণ করে না এবং স্বামী তার প্রতি অসন্তুষ্ট থাকে তার সম্পর্কে হাদীস শরীফে এসেছে যে, ‘তার কোনো নামায কবুল হয় না, কোনো নেক আমল উপরে উঠানো হয় না, যতক্ষণ স্বামী তার প্রতি সন্তুষ্ট না হবে। – ‘সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস ৫৩৫৫’
অন্য হাদীসে আছে-হুসাইন ইবনে মুহসিন থেকে বর্ণিত, তাঁর এক ফুফু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে কোনো প্রয়োজনে এসেছিলেন। তাঁর প্রয়োজন পূর্ণ হলে নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তুমি কি বিবাহিতা? তিনি বললেন, জ্বী হাঁ। নবীজী বললেন, তুমি স্বামীর সাথে কেমন আচরণ করে থাক? তিনি বললেন, আমি একেবারে অপারগ না হলে তার সেবা ও আনুগত্যে ত্রুটি করি না। তখন নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, স্বামীর সাথে তোমার আচরণ কেমন তা ভেবে দেখ। কারণ স্বামীই তোমার জান্নাত কিংবা জাহান্নাম। – ‘মুসনাদে আহমদ, খ. ৪-পৃ. ৩৪১৩; খ. ৬-পৃ. ৪১৯’
উত্তম স্বামী :
একটি পরিবার সুন্দর ও সুখময় করে গড়ে তোলার জন্য স্বামীর কর্তব্য সবচেয়ে বেশি। সুতরাং সে যেন স্ত্রীর খুটিনাটি বিষয় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ না করে এবং স্ত্রীকে সব কথা মেনে নেওয়ার জন্য বাধ্য না করে। কেননা নারীদেরকে সৃষ্টিই করা হয়েছে নাযুক তবিয়ত দিয়ে। অতএব স্ত্রীর ওপর অধিক চাপ প্রয়োগ করতে থাকলে হিতে বিপরীত হওয়ার আশংকাই বেশি।
হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে- রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নারীকে সৃষ্টি করা হয়েছে পাঁজরের হাড্ডি দ্বারা। তুমি যদি তাকে সোজা করতে যাও তাহলে ভেঙ্গে ফেলবে। তাই তার মন রক্ষা করে চলো। তাহলেই একসাথে জীবন-যাপন করতে পারবে। – ‘সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস ৪১৭৮’
আরেকটি হাদীসে আছে-রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা স্ত্রীদের সাথে উত্তম আচরণ কর। কেননা তাদেরকে পাঁজরের হাড্ডি থেকে সৃষ্টি করা হয়েছে। আর পাঁজরের হাড্ডিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বাঁকা হল উপরেরটি। সুতরাং তুমি যদি তা সোজা করতে যাও তাহলে ভেঙ্গে ফেলবে। আর যদি একেবারে ছেড়ে দাও তাহলে বাঁকাই থেকে যাবে। তাই স্ত্রীদের সাথে উত্তম আচরণ কর।’ – ‘সহীহ বুখারী ও মুসলিম’
অন্য হাদীসে এসেছে, তুমি যদি স্ত্রীকে সোজা করতে যাও তাহলে ভেঙ্গে ফেলবে। আর ভাঙ্গার অর্থ তাকে তালাক প্রদান করা। – ‘সহীহ মুসলিম’
অতএব স্বামী নিজেকে সংযত রাখবে। সবকিছু ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবে। ছাড় দেওয়া ও মায়া-মমতার মাধ্যমে যতদূর সম্ভব দাম্পত্য জীবন স্থায়ী করার আপ্রাণ চেষ্টা করবে। মাথা গরম করে দীর্ঘ দাম্পত্য জীবন এক নিমিষেই শেষ করে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
অবাধ্য স্ত্রীকে সংশোধনের কয়েকটি নির্দেশনা :
কোনো স্ত্রী যদি স্বামীর আনুগত্য না করে, স্বামীর হক আদায় না করে বরং উচ্ছৃঙ্খল জীবন-যাপন করতে থাকে তাহলে স্বামীর দায়িত্ব হল তাকে সংশোধনের জোর চেষ্টা করা। শরীয়ত এ ধরনের স্ত্রীকে সুশৃংখল জীবনে ফিরিয়ে আনতে কিছু দিক-নির্দেশনাও দিয়েছে। স্বামী প্রথমে সেগুলো অনুসরণ করবে। তারপরও যদি স্ত্রীর মধ্যে কোনো পরিবর্তন না আসে এবং সে তার মন মতোই চলতে থাকে তাহলে চূড়ান্ত ফয়সালা তালাক দেওয়ার পথ বেছে নিতে পারবে। তবে মনমতো তালাক দেওয়া যাবে না। শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত পদ্ধতিতে তালাক প্রদান করতে হবে।
১. স্ত্রীর এই অবাধ্যতা দেখে উত্তেজিত হবে না এবং ঝগড়া-বিবাদের পথ অবলম্বন করবে না; বরং নিজেকে সংযত রাখবে এবং স্ত্রীকে মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে বোঝাতে থাকবে। স্ত্রীর প্রতি মায়া-মুহাব্বত প্রকাশ করে তার মন গলানোর চেষ্টা করবে। স্ত্রী কোনো ভুল ধারণায় থাকলে যথাসম্ভব তা দূর করার চেষ্টা করবে। স্ত্রী যদি স্বামীর এই মহৎ আচরণে মুগ্ধ হয়ে নিজেকে স্বামীভক্ত বানিয়ে ফেলে তাহলে একটি সুখী পরিবার রচিত হবে এবং স্বামী অন্তর্জ্বালা থেকে মুক্তি পাবে। আর স্ত্রী অবাধ্য থাকার কারণে যে গুনাহে লিপ্ত ছিল তা থেকে সে পরিত্রাণ পাবে। যদি এই চেষ্টা বিফলে যায় তাহলে দ্বিতীয় নির্দেশনা অবলম্বন করবে।
২. স্ত্রীর ব্যবহারে রাগ-অনুরাগ প্রকাশ করার জন্য স্বামী স্ত্রীর সাথে একত্রে রাতযাপন করা থেকে বিরত থাকবে। স্ত্রীর ঘুমানোর জায়গা পৃথক করে দিবে। বাহ্যিক দৃষ্টিতে এটা সাধারণ একটি শাস্তি, কিন্তু মনস্তাত্বিক বিচারে সর্বোত্তম সতর্কবাণী। স্ত্রী যদি এতেই সতর্ক হয়ে যায় এবং নিজেকে সংশোধন করে নেয় তাহলে দাম্পত্য জীবন সুখের হবে। অশান্তি-পেরেশানী দূর হবে। আর যদি এই ভদ্রোচিত সাজা স্ত্রীর অবাধ্যতা ও বক্রতার মধ্যে কোনো পরিবর্তন না আনে তাহলে তৃতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে।
৩. উল্লেখিত দুটি পদক্ষেপ গ্রহণ করার পরও কোনো কাজ না হলে তৃতীয় পদক্ষেপ হিসেবে শরীয়ত স্ত্রীকে হালকা শাসন, হাত উঠানোর অনুমতি দিয়েছে। তবে রাগে ক্ষিপ্ত হয়ে নয়, বরং অন্তরে মুহাব্বত পোষণ করে বাহ্যিকভাবে স্ত্রীকে ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যে এটা করা যাবে। লক্ষ রাখতে হবে যেন এর কারণে তার শরীরে কোনো দাগ না পড়ে এবং চেহারা বা স্পর্শকাতর কোনো স্থানে আঘাত না আসে। অবশ্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্ত্রীদেরকে এ ধরনের শাস্তি দেওয়া পছন্দ করেননি। তাই এই পন্থা পরিত্যাগ করাই শ্রেয়। কেউ কেউ স্ত্রীকে শাসনের নামে বেধড়ক মারপিট করে থাকে, যা শরীয়ত সমর্থন করে না এবং এটা স্ত্রীর ওপর সুস্পষ্ট জুলুম। যা-হোক, এই যৎসামান্য শাসনের মাধ্যমেও যদি মোআমালা সাফ হয়ে যায় এবং উভয়ে আপোষ-মীমাংসায় পৌঁছে যায় তাহলেও মাকসাদ হাসিল হয়ে যাবে। ঘরে-সংসারে শান্তি ফিরে আসবে।
স্ত্রীকে সংশোধনের জন্য এই তিনটি পদক্ষেপ গ্রহণের কথা কুরআনুল কারীমের একটি আয়াতে একত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। ইরশাদ হয়েছে (তরজমা), ‘স্ত্রীদের মধ্যে যাদের অবাধ্যতার আশংকা কর তাদেরকে সদুপদেশ দাও। তারপর তাদের শয্যা বর্জন কর। অতঃপর তাদেরকে প্রহার কর। যদি তারা তোমাদের অনুগত হয় তবে তাদের বিরুদ্ধে কোনো পথ অন্বেষণ করো না।’
৪. উপরোক্ত পদক্ষেপগুলো এজন্য রাখা হয়েছে যেন স্বামী-স্ত্রীর ব্যক্তিগত সমস্যা তারা নিজেরাই সমাধান করতে পারে। কিন্তু কখনও কখনও ঝগড়া-বিবাদ এত চরম আকার ধারণ করে যে, চাই সেটা স্ত্রীর অবাধ্যতা ও বল্গাহীন চলাফেরা করার কারণে হোক কিংবা স্বামীর অন্যায় আচরণ, অমানবিক নির্যাতনের কারণে হোক তখন আর ঘরের কথা ঘরে থাকে না বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। এতে সাধারণত দেখা যায়, এক পক্ষের লোক অন্য পক্ষ সম্পর্কে কটুক্তি করে এবং অপবাদ রটাতে থাকে। যার ফলে উভয় পরিবার ও পক্ষ-বিপক্ষের লোকদের মাঝে হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে এটা পারিবারিক কোন্দল থেকে বংশীয় কোন্দলে পরিণত হয়।
কুরআনুল করীমে এই বিবাদ-বিসম্বাদ দূর করার জন্য এবং পরস্পর সুস্থ আপোষ-মীমাংসায় উপনীত হওয়ার জন্য একটি স্বচ্ছ ও কার্যকরী পদ্ধতি উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-(তরজমা), ‘যদি স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কচ্ছেদ হওয়ার মতো পরিস্থিতির আশংকা কর তাহলে স্বামীর পরিবার থেকে একজন এবং স্ত্রীর পরিবার থেকে একজন সালিস নিযুক্ত করবে। তারা উভয়ে নিষ্পত্তি চাইলে আল্লাহ তাদের মধ্যে মীমাংসার অনুকূল অবস্থা সৃষ্টি করবেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ সর্বজ্ঞ।’ – ‘সূরা নিসা ৩৫’। তবে উভয় সালিসের মধ্যে নিন্মোক্ত গুণাবলী থাকা আবশ্যক।
১. জ্ঞানী হওয়া, ২. সুবিবেচক হওয়া, ৩. নেক নিয়তে ফয়সালা করার মানসিকতা থাকা।
অর্থাৎ তাদের অন্তরের একান্ত কামনা থাকবে যে, স্বামী স্ত্রীর মাঝে একটি সুষ্ঠু ফয়সালা হোক। এজন্য তারা যথাসাধ্য চেষ্টাও করবে। যখন এই সালিসদ্বয় ইখলাসের সাথে স্বামী-স্ত্রীর মাঝে মীমাংসা করার জন্য প্রচেষ্টা চালাবে তখন আল্লাহ তা-আলার গায়েবী মদদ তাদের সাথে থাকবে। ফলে তাদের বিচারকার্যের মাকসাদ হাসিল হবে এবং তাদের অসীলায় আল্লাহ তা-আলা স্বামী-স্ত্রী উভয়ের অন্তরে মুহাব্বত ও সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি করে দিবেন। ‘ইনশাআল্লাহ।’
৫. তালাক হল চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। পরিস্থিতি কখনো এমন নাযুক হয়ে যায় যে, মীমাংসা ও সংশোধনের সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়। কোনোক্রমেই একমতে পৌঁছা সম্ভব হয় না। দাম্পত্য জীবন থেকে সাফল্য লাভ হওয়া তো দূরের কথা, একে অপরের চেহারা পর্যন্ত দেখতে চায় না। যতদ্রুত সম্ভব বিচ্ছেদ ঘটালেই তারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। এরকম চূড়ান্ত পর্যায়ে গেলে শরীয়ত স্বামীকে তালাক দেওয়ার এখতিয়ার দিয়েছে। তবে তালাক দেওয়া অত্যন্ত অপছন্দনীয় ও ঘৃণিত কাজ। তারপরও তালাক দেওয়া ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা না থাকলে শরীয়ত সমর্থিত পদ্ধতি অনুসরণ করে তালাক দিবে। এই পদ্ধতি অনুসরণ করার সুফল অনেক।