০৮:২১ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ০৭ জানুয়ারী ২০২৫

চাঁদপুরের প্রতিপক্ষের ভয়ে আড়াই মাস ভিটে ছাড়া ৫৫টি পরিবার ‘বন্ধ রয়েছে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া’

রিপোর্টার
  • আপডেট সময় : ১০:০৬:৪৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩
  • / ৫৯

সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

স্টাফ রিপোর্টার:

উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে সবেমাত্র এসএসসি পাশ করে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছে রিয়ামনি (১৭) । সহপাঠিরা যখন আনন্দচিত্তে উচ্চমাধ্যমিকে পড়তে ইন্টারে ভর্তির জন্য আবেদন করছে, রিয়ামনি তখন মা-বাবার সাথে পালিয়ে বেড়াচ্ছে জীবনের ভয়ে। সন্ত্রাসীরা তাদের বসত ঘর, আসবাবপত্র, স্বর্ণালংকার এবং গবাদি পশুর সাথে, এসএসসি পরীক্ষার মার্কসিটও নিয়ে গেছে। ফলে ইন্টারে ভর্তির আবেদন করতে পারছে না, উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখা এ গ্রাম্য কিশোরী। তবে পরিবারের সাথে পালিয়ে বেড়ালেও লুকিয়ে চলমান এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে একই গ্রামের সিয়াম হোসেন। এই ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা ঘটনাগুলোর বর্ণনা দেন এভাবেই সাংবাদিকদের কাছে।
গত আড়াই মাস ধরে এভাবেই নিজেদের ভিটেমাটি ফেলে পালিয়ে বেড়াচ্ছে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ৬নং ওযার্ডের বাহাদুরপুর গ্রামের চরবাসী ৫৫টি পরিবার। ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে বেড়ানো এই ৫৫টি পরিবারের ছেলেমেয়েরা বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষাজীবন থেকে। তাদের অভিযোগ, সন্ত্রাসীরা বাড়িঘর লুটকরে গ্রাম তাদের থেকে বের করে দিয়েছে। প্রাণের ভয়ে তারা বাপ-দাদার ভিটে ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
ভুক্তভোগী অসহায় চরবাসীরা জানান, গত ২৭ জুন মতলব উত্তরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে মোবারক হোসেন বাবু নামে এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধে নিহত হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেই রাতে মোহনপুরে বাহাদুরপুর গ্রামে চড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মত হামলা চালায় সুবিধাভোগী একটি সন্ত্রাসী চক্র। রাজনীতিক এই হাত্যাকাণ্ডকে হাতিয়ার বানিয়ে সুবিধাভোগী সন্ত্রাসী চক্রটি নিরীহ চরবাসীর বাড়িঘর লুট করে।তারা রাতের অন্ধকারে ৫৫টি পরিবারে বাড়িতে লুট করে, ১২০টি বসতঘর, ১৭০টি গরু এবং ১৪টি মাছ ধরাার ট্রলারসহ টাকা, স্বর্ণালংকার, মোবাইল ও ঘরের সকল আসবাবপত্র নিয়ে গেছে। সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি বসতভিটার গাছপালাও। রাতের অন্ধকারে নিরস্র চরবাসী নারী-পুরুষরা তাদের শিশু সন্তানদের নিয়ে কোনরকম পালিয়ে বাঁচতে সক্ষম হয়। সেই থেকে আজ অবদি (দীর্ঘ আড়াই মাস ধরে) বাপ-দাদার ভিটেমাটিকে তাদের প্রবেশও করতে দিচ্ছে না। এই ঘটনার বিচার চেয়ে ১০টি পরিবার আলাদা আলাদা ভাবে আদালতে মামলা দায়ের করেছে। এরপরেও তারা বসতভিটায় প্রবেশ করতে পারছে না।
ভিটে মাটি ছেড়ে পালিয়ে বেড়ানো রাজ্জাক প্রধানের মেয়ে হোসনেয়ারা বলেন, ডাকাতরা আমার ৩ ভাইয়ের ৩ টি ঘর, ফ্রিজ, ফার্নিচার, টাকা, স্বর্ণালংকার এবং আসবাবপত্র সবকিছু লুট করে নিয়ে গেছে। আমি শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে ক্ষেতের ভিতরে লুকিয়ে জীবন বাঁচিয়েছি। বর্তমানে আমরা আমিরাবাদ এলাকায় বাসা ভাড়া করে থাকছি। আমরা বসতভিটায় ফিরে যেতে চাই। কিন্তু সেই রাতের লুটপাটের নেতৃত্ব দেওয়া আমির হোসেন কালু, আলমগীর মেম্বার, ননী শিকদার ও বাবুল গংরা আমাদের বাড়িতে যেতে দিচ্ছে না বলে জানান তারা।
সোলেমান ঢালির স্ত্রী ষাটর্ধো মর্জিনা বেগম জানান, ডাকাতরা আমার এবং আমার ভাসুর ও ননদেরসহ ৬টি ঘর লুট করেছে। তারা আমাদের ভিটেমাটির ইটগুলোও খুলে নিয়ে গেছে। ঘরের একটু চিহ্নও অবশিষ্ট রাখিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজাকাররা যেভাবে নিরীহ বাঙালিদের ঘরবাড়ি লুট করেছে, তেমন করে সন্ত্রাসীরা আমাদের বসতঘরে লুট করেছে। বর্তমানে আমরা ঢাকার বাসা ভাড়া করে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
আনোয়া হোসেনের স্ত্রী শ্যামলী বেগম বলেন, ডাকাতরা তার ৩টা ঘর, ৪টা গরু, ৩ভরি স্বর্ণ, ফ্রিজ, দেড় লক্ষ টাকাসহ সবকিছু নিয়ে গেছে। এমনকি হাতের মোবাইল, বাচ্চাদের বই পত্রও রক্ষা পায়নি।
তিনি জানান, প্রথমে বাবুল প্রধান সন্ত্রাসীদের বাড়ির লুট করার নির্দেশ দেয়। এরপর লুট শেষ হলে আলমগীর মেম্বার বলে ‘কাজ শেষ হয়ে গেছে, সবাই চল।’ বর্তমানে তার পরিবার নারায়নগঞ্জের মুক্তারপুর এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকছেন বলে তিনি জানান।
আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী আকলিমা বেগম বলেন, ‘বাড়িতে আমাদের ২টা ঘর এবং ৫ ভাইয়ের ৫টা ঘর। বাড়ির বেশিরভাগ পুরুষ বিদেশে থাকে। সেদিনের রাতে ডাকাত দল আমাদের ৭টা ঘর, ২৫টি গরু, নগদ ৭ লক্ষ টাকা এবং ৩০-৪০ ভরি স্বর্ণ নিয়ে গেছে। বাড়িতে এখন শুধু খালি ভিটেমাটি পড়ে আছে। সন্ত্রাসীরা আমাদেরকে ভিটেমাটিতেও যদি যেতে দিচ্ছে না। আমাদের সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে আছে।

মুসা গাজীর স্ত্রী মনসুরা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, ৩টা ঘরের সকল ফার্নিচার, আসবাবপত্র, আইপিএস নিয়ে গেছে। সন্ত্রাসীরা নারীদের শরীরেও হাত দেয়ার চেষ্টা করেছে। বর্মমানে আমরা পালিয়ে বেঁচে আছি। এই আড়াই মাস ধরে আমার ৩টা মেয়ের লেখাপড়াও বন্ধ।
চলমান এইচএসসি পরীক্ষার্থী সিয়াম হোসেন বলেন, আমি ছেলে বলে জীবনের মায়া ত্যাগ করে কোনরকম লুকিয়ে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছি। কিন্তু আমার অনেক প্রতিবেশী ভাই-বোনরা পরীক্ষা দিতে পারেনি। আমি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করব, বাহাদুরপুর গ্রামের শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করা হলেও যেন আমাদেরকে বসতবাড়িতে ফিরে যাবার সুযোগ করে দেয়া হয়।
এদিকে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্ষতিগ্রস্ত ৫৫ পরিবারের মধ্যে ১০ পরিবারের প্রতিনিধিরা আলাদাভাবে আদালতে ১০টি মামলা দায়ের করেছে। মামলার বাদিরা হলেন, সোলেমান ঢালী (মামলা, নং, সিআর ২২৯/ ২৩, তারিখ ২৫/৬/২০২৩) আকলিমা আক্তার, (মামলা নং সিআর ২৩৬/২৩, তারিখ ২৫/০৬/২৩, মানসুর আক্তার (মামলা নং সিআর ২৪২/২৩, তারিখ ৪-৭-২০২৩), হোসনেয়ারা (মামলা নং ২৪৩, তারিখ ৪-৭-২০২৩) ফরিদা ডাক্তার, (মামলা নং সিআর ২৪৪/ ২৩, তারিখ ৫-৭-২০২৩) উকিল ঢালী, ( মামলা নং সিআর ৩০৬/ ২৩, তারিখ ১৭-৮ ২৩), নুরুল হক (মামলা নং ৩১৩/২৩, তারিখ ১৭-৮-২৩), তাফাজ্জল (মামলা নং ৩১২/২৩), তারিখ ১৭-৮-২০২৩), শিল্পী বেগম, (মামলা নং সিআর ৩১২/২৩, তারিখ ১৭-৮-২০২৩), দুলাল ঢালী (মামলা নং সিআর ৩৩৪/২৩, তারিখ ২৯-০৮- ২০২৩)।
এসব মামলার বেশিরভাগ আমির হোসেন কালু ও আলমগীর মেম্বারকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে আদালত থেকে মামলা তদন্তবার চাঁদপুর ডিবি পুলিশকে প্রদান করা হয়। এছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে চাঁদপুর পুলিশ সুপার বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছেন। পাশাপাশি মতলবের কৃতি সন্তান পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম এবং স্থানীয় সাংসদ অ্যাড. রুহুল আমিনকে অবগত করে তাদের সহযোগিতা কামনা করেছেন।
গত ২ শনিবার সেপ্টেম্বর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাশেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে জেলা পুলিশ ও ডিবি পুলিশের একটি টিম মামলা তদন্তে গেলে এ সময় জেলা পুলিশের এ উর্ধতন কর্মকর্তা ভুক্তভোগী অসহায় পরিবারগুলোর সাথে কথা বলেন। তখন অসহায় পরিবারগুলো কান্না জড়িত কন্ঠে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের কাছে নিজেদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার আকুতি জানান।

এ বিষয়ে চাঁদপুর জেলা গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এনামুল হক বলেন, মামলা গুলো গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে। গতকাল মামলা গুলোর সরজমিনে তদন্ত করা হয়েছে। দু’টো ঘটনার সুষ্ঠুভাবে তদন্ত সম্পন্ন করে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো যাতে করে পুনরায় তাদের বসতবাড়িতে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারে সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।


সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

বিজ্ঞাপন

সাবধান
এই পৃষ্ঠার বিষয়বস্তু কপি করতে পারবেন না

চাঁদপুরের প্রতিপক্ষের ভয়ে আড়াই মাস ভিটে ছাড়া ৫৫টি পরিবার ‘বন্ধ রয়েছে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া’

আপডেট সময় : ১০:০৬:৪৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩
সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

স্টাফ রিপোর্টার:

উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন নিয়ে সবেমাত্র এসএসসি পাশ করে মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরিয়েছে রিয়ামনি (১৭) । সহপাঠিরা যখন আনন্দচিত্তে উচ্চমাধ্যমিকে পড়তে ইন্টারে ভর্তির জন্য আবেদন করছে, রিয়ামনি তখন মা-বাবার সাথে পালিয়ে বেড়াচ্ছে জীবনের ভয়ে। সন্ত্রাসীরা তাদের বসত ঘর, আসবাবপত্র, স্বর্ণালংকার এবং গবাদি পশুর সাথে, এসএসসি পরীক্ষার মার্কসিটও নিয়ে গেছে। ফলে ইন্টারে ভর্তির আবেদন করতে পারছে না, উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখা এ গ্রাম্য কিশোরী। তবে পরিবারের সাথে পালিয়ে বেড়ালেও লুকিয়ে চলমান এইচএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছে একই গ্রামের সিয়াম হোসেন। এই ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা ঘটনাগুলোর বর্ণনা দেন এভাবেই সাংবাদিকদের কাছে।
গত আড়াই মাস ধরে এভাবেই নিজেদের ভিটেমাটি ফেলে পালিয়ে বেড়াচ্ছে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার ৬নং ওযার্ডের বাহাদুরপুর গ্রামের চরবাসী ৫৫টি পরিবার। ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে বেড়ানো এই ৫৫টি পরিবারের ছেলেমেয়েরা বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষাজীবন থেকে। তাদের অভিযোগ, সন্ত্রাসীরা বাড়িঘর লুটকরে গ্রাম তাদের থেকে বের করে দিয়েছে। প্রাণের ভয়ে তারা বাপ-দাদার ভিটে ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।
ভুক্তভোগী অসহায় চরবাসীরা জানান, গত ২৭ জুন মতলব উত্তরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে মোবারক হোসেন বাবু নামে এক ব্যক্তি গুলিবিদ্ধে নিহত হয়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেই রাতে মোহনপুরে বাহাদুরপুর গ্রামে চড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর মত হামলা চালায় সুবিধাভোগী একটি সন্ত্রাসী চক্র। রাজনীতিক এই হাত্যাকাণ্ডকে হাতিয়ার বানিয়ে সুবিধাভোগী সন্ত্রাসী চক্রটি নিরীহ চরবাসীর বাড়িঘর লুট করে।তারা রাতের অন্ধকারে ৫৫টি পরিবারে বাড়িতে লুট করে, ১২০টি বসতঘর, ১৭০টি গরু এবং ১৪টি মাছ ধরাার ট্রলারসহ টাকা, স্বর্ণালংকার, মোবাইল ও ঘরের সকল আসবাবপত্র নিয়ে গেছে। সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি বসতভিটার গাছপালাও। রাতের অন্ধকারে নিরস্র চরবাসী নারী-পুরুষরা তাদের শিশু সন্তানদের নিয়ে কোনরকম পালিয়ে বাঁচতে সক্ষম হয়। সেই থেকে আজ অবদি (দীর্ঘ আড়াই মাস ধরে) বাপ-দাদার ভিটেমাটিকে তাদের প্রবেশও করতে দিচ্ছে না। এই ঘটনার বিচার চেয়ে ১০টি পরিবার আলাদা আলাদা ভাবে আদালতে মামলা দায়ের করেছে। এরপরেও তারা বসতভিটায় প্রবেশ করতে পারছে না।
ভিটে মাটি ছেড়ে পালিয়ে বেড়ানো রাজ্জাক প্রধানের মেয়ে হোসনেয়ারা বলেন, ডাকাতরা আমার ৩ ভাইয়ের ৩ টি ঘর, ফ্রিজ, ফার্নিচার, টাকা, স্বর্ণালংকার এবং আসবাবপত্র সবকিছু লুট করে নিয়ে গেছে। আমি শিশুসন্তানকে কোলে নিয়ে ক্ষেতের ভিতরে লুকিয়ে জীবন বাঁচিয়েছি। বর্তমানে আমরা আমিরাবাদ এলাকায় বাসা ভাড়া করে থাকছি। আমরা বসতভিটায় ফিরে যেতে চাই। কিন্তু সেই রাতের লুটপাটের নেতৃত্ব দেওয়া আমির হোসেন কালু, আলমগীর মেম্বার, ননী শিকদার ও বাবুল গংরা আমাদের বাড়িতে যেতে দিচ্ছে না বলে জানান তারা।
সোলেমান ঢালির স্ত্রী ষাটর্ধো মর্জিনা বেগম জানান, ডাকাতরা আমার এবং আমার ভাসুর ও ননদেরসহ ৬টি ঘর লুট করেছে। তারা আমাদের ভিটেমাটির ইটগুলোও খুলে নিয়ে গেছে। ঘরের একটু চিহ্নও অবশিষ্ট রাখিনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় রাজাকাররা যেভাবে নিরীহ বাঙালিদের ঘরবাড়ি লুট করেছে, তেমন করে সন্ত্রাসীরা আমাদের বসতঘরে লুট করেছে। বর্তমানে আমরা ঢাকার বাসা ভাড়া করে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
আনোয়া হোসেনের স্ত্রী শ্যামলী বেগম বলেন, ডাকাতরা তার ৩টা ঘর, ৪টা গরু, ৩ভরি স্বর্ণ, ফ্রিজ, দেড় লক্ষ টাকাসহ সবকিছু নিয়ে গেছে। এমনকি হাতের মোবাইল, বাচ্চাদের বই পত্রও রক্ষা পায়নি।
তিনি জানান, প্রথমে বাবুল প্রধান সন্ত্রাসীদের বাড়ির লুট করার নির্দেশ দেয়। এরপর লুট শেষ হলে আলমগীর মেম্বার বলে ‘কাজ শেষ হয়ে গেছে, সবাই চল।’ বর্তমানে তার পরিবার নারায়নগঞ্জের মুক্তারপুর এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকছেন বলে তিনি জানান।
আনোয়ার হোসেনের স্ত্রী আকলিমা বেগম বলেন, ‘বাড়িতে আমাদের ২টা ঘর এবং ৫ ভাইয়ের ৫টা ঘর। বাড়ির বেশিরভাগ পুরুষ বিদেশে থাকে। সেদিনের রাতে ডাকাত দল আমাদের ৭টা ঘর, ২৫টি গরু, নগদ ৭ লক্ষ টাকা এবং ৩০-৪০ ভরি স্বর্ণ নিয়ে গেছে। বাড়িতে এখন শুধু খালি ভিটেমাটি পড়ে আছে। সন্ত্রাসীরা আমাদেরকে ভিটেমাটিতেও যদি যেতে দিচ্ছে না। আমাদের সন্তানদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে আছে।

মুসা গাজীর স্ত্রী মনসুরা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, ৩টা ঘরের সকল ফার্নিচার, আসবাবপত্র, আইপিএস নিয়ে গেছে। সন্ত্রাসীরা নারীদের শরীরেও হাত দেয়ার চেষ্টা করেছে। বর্মমানে আমরা পালিয়ে বেঁচে আছি। এই আড়াই মাস ধরে আমার ৩টা মেয়ের লেখাপড়াও বন্ধ।
চলমান এইচএসসি পরীক্ষার্থী সিয়াম হোসেন বলেন, আমি ছেলে বলে জীবনের মায়া ত্যাগ করে কোনরকম লুকিয়ে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছি। কিন্তু আমার অনেক প্রতিবেশী ভাই-বোনরা পরীক্ষা দিতে পারেনি। আমি মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর কাছে অনুরোধ করব, বাহাদুরপুর গ্রামের শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করা হলেও যেন আমাদেরকে বসতবাড়িতে ফিরে যাবার সুযোগ করে দেয়া হয়।
এদিকে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ক্ষতিগ্রস্ত ৫৫ পরিবারের মধ্যে ১০ পরিবারের প্রতিনিধিরা আলাদাভাবে আদালতে ১০টি মামলা দায়ের করেছে। মামলার বাদিরা হলেন, সোলেমান ঢালী (মামলা, নং, সিআর ২২৯/ ২৩, তারিখ ২৫/৬/২০২৩) আকলিমা আক্তার, (মামলা নং সিআর ২৩৬/২৩, তারিখ ২৫/০৬/২৩, মানসুর আক্তার (মামলা নং সিআর ২৪২/২৩, তারিখ ৪-৭-২০২৩), হোসনেয়ারা (মামলা নং ২৪৩, তারিখ ৪-৭-২০২৩) ফরিদা ডাক্তার, (মামলা নং সিআর ২৪৪/ ২৩, তারিখ ৫-৭-২০২৩) উকিল ঢালী, ( মামলা নং সিআর ৩০৬/ ২৩, তারিখ ১৭-৮ ২৩), নুরুল হক (মামলা নং ৩১৩/২৩, তারিখ ১৭-৮-২৩), তাফাজ্জল (মামলা নং ৩১২/২৩), তারিখ ১৭-৮-২০২৩), শিল্পী বেগম, (মামলা নং সিআর ৩১২/২৩, তারিখ ১৭-৮-২০২৩), দুলাল ঢালী (মামলা নং সিআর ৩৩৪/২৩, তারিখ ২৯-০৮- ২০২৩)।
এসব মামলার বেশিরভাগ আমির হোসেন কালু ও আলমগীর মেম্বারকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। ইতোমধ্যে আদালত থেকে মামলা তদন্তবার চাঁদপুর ডিবি পুলিশকে প্রদান করা হয়। এছাড়াও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার তাদের বাড়িতে ফিরে যেতে চাঁদপুর পুলিশ সুপার বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছেন। পাশাপাশি মতলবের কৃতি সন্তান পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম এবং স্থানীয় সাংসদ অ্যাড. রুহুল আমিনকে অবগত করে তাদের সহযোগিতা কামনা করেছেন।
গত ২ শনিবার সেপ্টেম্বর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রাশেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে জেলা পুলিশ ও ডিবি পুলিশের একটি টিম মামলা তদন্তে গেলে এ সময় জেলা পুলিশের এ উর্ধতন কর্মকর্তা ভুক্তভোগী অসহায় পরিবারগুলোর সাথে কথা বলেন। তখন অসহায় পরিবারগুলো কান্না জড়িত কন্ঠে অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের কাছে নিজেদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার আকুতি জানান।

এ বিষয়ে চাঁদপুর জেলা গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) অফিসার ইনচার্জ (ওসি) এনামুল হক বলেন, মামলা গুলো গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে। গতকাল মামলা গুলোর সরজমিনে তদন্ত করা হয়েছে। দু’টো ঘটনার সুষ্ঠুভাবে তদন্ত সম্পন্ন করে, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো যাতে করে পুনরায় তাদের বসতবাড়িতে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে পারে সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।


সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন