চড়ক পূজাসহ নানা আয়োজনে নেত্রকোনায় বর্ষবরণ
- আপডেট সময় : ১০:৪৪:৫০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৪ এপ্রিল ২০২৩
- / ৬৩
রিপন কান্তি গুণ,নেত্রকোনা:
‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা, অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা’- এই স্লোগানকে সামনে রেখে সারাদেশের ন্যায় নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে নেত্রকোনায় পালিত হয়ছে বাঙালি জাতির প্রাণের উৎসব ‘পহেলা বৈশাখ’।
সকল হতাশা দুঃখ দূর্দশাকে পাশ কাটিয়ে কালের চক্র পূর্ণ করে আমাদের মাঝে আবারো চলে এলো পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ-১৪৩০।
বাঙ্গালীর ঐতিহ্য পহেলা বৈশাখ। আবহমান কাল ধরে দেশের মানুষ ধর্ম-বর্ণ, দল-মত নির্বিশেষে দিনটিকে উৎসব হিসাবে পালন করে আসছে। প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও নেত্রকোণানায় ব্যাপক আয়োজনের মধ্য দিয়ে ১৪৩০ বঙ্গাব্দকে বরণ করা হল।
আজ (১৪ এপ্রিল) শুক্রবার নেত্রকোনায় বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা, আলোচনা ক্ষুদ্র ও কুঠিরশিল্প, মৃতশিল্প মেলাসহ নানা আয়োজনের মধ্যদিয়ে বাংলা বর্ষবরণ ১৪৩০ আনন্দ ও উচ্ছ্বাসের মধ্য দিয়ে নানা আয়োজনে বাংলা নববর্ষ উদযাপিত হয়েছে।
বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের শুরুতে আজ সকাল ৯টায় জেলা শহরের মোক্তারপাড়া মাঠে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে বর্ষবরণ ও সংগীতানুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। পরে জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশের নেতৃত্বে একটি বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয়ে শহরের প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুরাতন কালেক্টর মাঠে এসে শেষ হয়।
পুরাতন কালেক্টর মাঠে জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংসদ সদস্য হাবিবা রহমান খান শেফালী।
এসময় অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন, জেলা পুলিশ সুপার মোঃ ফয়েজ আহমেদ, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান প্রতিরোধযোদ্ধা এডভোকেট অসিত সরকার সজল, জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা এডভোকেট আমিরুল ইসলাম, পৌরসভার মেয়র বীর মুক্তিযোদ্ধা নজরুল ইসলাম খানসহ বিভিন্ন সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ ও আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দসহ সাংস্কৃতিক কর্মী ও সর্বস্তরের মানুষ।
বর্ষবরণের আয়োজনে সকাল থেকেই জেলা উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, প্রত্যাশা সাহিত্য গোষ্ঠী, শতদলসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বর্নাঢ্য র্যালী, সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি, রাখি বন্ধন ও আলোচনার মধ্যদিয়ে বর্ষবরণ উদযাপন করেছে।
এছাড়াও বর্ষবরণ উৎসব উদযাপন উপলক্ষে পুরাতন কালেক্টর মাঠে বসেছে ক্ষুদ্র ও কুঠিরশিল্প, মৃতশিল্প মেলাসহ নানা ধরনের মেলা।
অপরদিকে নেত্রকোণা আদর্শ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে নেত্রকোণা জেলা উদীচী শিল্পী গোষ্টী এবং নাগড়া তালুকদার ভবনে প্রত্যাশা সাংস্কৃতিক একাডেমীর পরিবেশনায় সংগীত, নৃত্য, আবৃত্তি, রাখি বন্ধন ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।
এছাড়াও সারাদেশের ন্যায় প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা চড়ক পুজা বারহাট্টা উপজেলার সদর ইউনিয়নের গড়মা গ্রামে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসব চড়ক পূজা আয়োজন করা হয়।
পূজার প্রচীন ইতিহাস থেকে জানাযায়, প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা, চড়ক পূজার অপর নাম নীল পূজা, মহাদেব পূজা, গম্ভীরা পূজা বা শিবের গাজন পূজা। শিব-পুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে চৈত্রে শিব আরাধনা প্রসঙ্গে নৃত্যগীতাদি ও ধর্মীয় নাটক উৎসবের উল্লেখ রয়েছে।
পূজার ঐতিহ্য হিসাবে, বেল কাস্ট নির্মিত মহাদেবকে চৈত্রমাসের ১৫ দিন, ১১ দিন,৭দিন,৩দিন বা দিনের দিন স্নান করিয়ে সিঁদুর ও সরিষার তেল মাখানো হয়।তারপর লালচি দিয়ে ভালভাবে জড়ানো হয়।
পরানো হয় আকন্দ, জবা,বেলী, গন্ধাঁ ফুলের মালা সহ বেল পাতার তৈরি মালা। লাগানো হয় স্বর্ণের চোখ।তারপর বাড়ী বাড়ী ঘুরে সংগ্রহ করা হয় চাল, তরকারী,ফল, বাতসা আর টাকা। চড়ক গাছের ক্ষেত্রে আগের দিন চড়ক গাছটিকে ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করা হয়। এতে জলভরা একটি পাত্রে শিবের প্রতীক শিবলিঙ্গ রাখা হয়, যা পূজারিদের কাছে “শিবঘট “বা‘বুড়োশিব’ নামে পরিচিত।ব্রাহ্মণ এ পূজার পুরোহিতের দায়িত্ব পালন করেন। পূজার বিশেষ বিশেষ অঙ্গ হলো কুমিরের পূজা, জ্বলন্ত অঙ্গারের ওপর হাঁটা, কাঁটা আর ছুঁড়ির ওপর লাফানো, বাণফোঁড়া, শিবের বিয়ে, অগ্নিনৃত্য,খেঁজুর ভাঙ্গা, চড়কগাছে দোলা এবং হাজরা পূজা করা।
এই সব পূজার মূলে রয়েছে ভূতপ্রেত ও পুনর্জন্মবাদের ওপর বিশ্বাস। পূজার উৎসবে বহু প্রকারের দৈহিক যন্ত্রণা ধর্মের অঙ্গ বলে বিবেচিত হয়। চড়কগাছে ভক্ত বা সন্ন্যাসীকে লোহার হুক দিয়ে চাকার সঙ্গে বেঁধে দ্রুতবেগে ঘোরানো হয়। তার পিঠে, হাতে, পায়ে, জিহ্বায় এবং শরীরের অন্যান্য অঙ্গে বাণ শলাকা বিদ্ধ করা হয়। কখনো কখনো জ্বলন্ত লোহার শলাকা তার গায়ে ফুঁড়ে দেওয়া হয়।
সর্ব স্তরের লোকদের মধ্যে এ অনুষ্ঠানের প্রচলন খুব প্রাচীন। তবে নিম্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রাচীনকালে এ উৎসব প্রচলিত ছিল। চড়ক পূজা চৈত্রসংক্রান্তিতে অর্থাৎ চৈত্র মাসের শেষ দিবসে পালিত হয়। এ পূজায় কোন ব্রাহ্মনের প্রয়োজন পড়ে না।
পূজার উদ্যোক্তারা কয়েকজনের একটি দল চড়ক পূজার শুরুতে শিবপাঁচালী পাঠক মন্ত্রপড়া শুরু করলে সন্ন্যাসীরা শিবধ্বনি দিতে দিতে নদীতে স্নান করতে যান। স্নান শেষ করে মাটির কলসি ভরে জল আনেন তারা। এরপর চড়ক গাছের গোড়ায় গোল হয়ে দাঁড়ান সন্ন্যাসীরা। আবার শিবপাঁচালী পাঠ করতে থাকেন বালা বা শিবপাঁচালী পাঠক।
সন্ন্যাসীরা চড়ক গাছে জল ঢেলে প্রমাম করে চলে যান ফাঁকা জায়গায়। সেখানেই তাদের বাণবিদ্ধ করা হয়। সন্ন্যাসীরা নিজের শরীর বড়শিতে বিঁধে চড়কগাছে ঝুলে শূণ্যে ঘুরতে থাকেন। আবার সন্ন্যাসীর আর্শীবাদ লাভের আশায় শিশু সন্তানদের শূন্যে তুলে দেন অভিভাবকরা। সন্ন্যাসীরা ঘুরতে ঘুরতে কখনও কখনও শিশুদের মাথায় হাত দিয়ে আর্শীবাদও করেন। এ অবস্থায় একহাতে বেতের তৈরি বিশেষ লাঠি ঘুরাতে থাকেন আর অন্য হাতে দর্শনার্থীদের উদ্দেশ্যে বাতাসা ছড়ান। এই ঝুলন্ত সন্ন্যাসীরা তাদের বিশ্বাস জগতে যারা শিব ঠাকুরের সন্তুষ্টি লাভের জন্য স্বেচ্ছায় এত কঠিন আরাধনার পথ বেছে নিয়েছেন বিনিময়ে পরলোকে শিবঠাকুর তাদের স্বর্গে যাওয়ার পথ সুগম করে দেবেন।
চৈত্র সংক্রন্তির ১৫ অথবা ৭ দিন আগ থেকে শুরু হয় চড়কের প্রস্ততি। উৎসবের আমেজ শুরু হয় গ্রামের বারোয়ারি তলায়, শ্মশানে কিংবা গৃহস্থ বাড়ির আঙিনায়। যেখানে আর যেভাবেই এই উৎসব উপস্থাপিত হোক না কেন এর মূল লক্ষ্য থাকে দেবতা শিবের আবাহন। শিবই এই উৎসবের মুখ্য। তাই শিবকে সন্তুষ্ট করাই পূজারীদের উদ্দেশ্য। শিব দেবতা বা মহেশ্বরের পূজা মানেই নীল পূজা আর এই পূজায় বয়ে আনবে চরম মোক্ষ লাভ।
চড়ক পুজার ঐতিহ্য হিসাবে পুজাতে নানা ধরনের অলৌকিক খেলা দেখানো হয়ে থাকে। পুজা এবং এসব খেলা দেখতে অনেক দুরদুরান্ত থেকে মানুষ উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে পুজা ও এসব খেলা দেখতে আসেন।